আল মুওয়াত্তা-ইমাম মুহাম্মাদ রহঃ
موطأ الإمام مالك برواية الإمام محمد بن الحسن الشيباني
ইমাম মুহাম্মাদ (র)
ইসলামী জ্ঞানচর্চার জগতে ইমাম মুহাম্মাদ (র) এক অনন্য ব্যক্তিত্ব। তার আবির্ভাব না হলে ইলমে ফিক্হের বিরাট অংশ হয়তো অপূর্ণই থেকে যেতো। তার নাম মুহাম্মাদ, কুনিয়াত (উপনাম) আবু আবদুল্লাহ, পিতার নাম হাসান এবং দাদার নাম ফারকাদ আশ-শায়বানী। তার বংশ জাযীরাতুল আরবে বসবাস করতো। তার পিতা পরিবার-পরিজনসহ দেশত্যাগ করে এসে সিরিয়ার সেনাবাহিনীতে যোগদান করেন এবং দামেশক শহরের অদূরে হারিসতা (حرستا) গ্রামে বসতি স্থাপন করেন। অতঃপর তারা উমাইয়া রাজত্বের শেষদিকে ইরাকে চলে আসেন। ইমাম মুহাম্মাদ (র) ১৩১-৩২ হিজরী সনে (৭৪৮-৯ খৃ.) ইরাকের ওয়াসিত (واسط) শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা তাকে নিয়ে কুফা চলে আসেন এবং এখানকার আলো-বাতাসেই তিনি বড়ো হতে থাকেন। ইমাম সাহেব বলেন, আমার পিতা আমার জন্য ৩০ হাজার দিরহাম রেখে যান। আমি এর ১৫ হাজার আরবী ব্যাকরণ ও কবিতা শেখায় এবং অবশিষ্ট ১৫ হাজার হাদীস ও ফিক্হের জ্ঞান অর্জনে ব্যয় করি" (ইমাম যাহাবীর মানাকিবে আবু হানীফা ওয়া সাহিবাইহি)। তিনি সমসাময়িক যুগের প্রখ্যাত মুহাদ্দিস ও ফিক্হবিদদের নিকট থেকে জ্ঞান অর্জন করেন। এ সম্পর্কে আল্লামা ইবনে হাজার আল আসকালানী (র) বলেন, তিনি ইমাম আবু হানীফা (র)-এর সাহচর্য গ্রহণ করেন এবং তার কাছে হাদীস ও ফিক্হের জ্ঞান লাভ করেন। অনন্তর তিনি আমর ইবনে দীনার, মালেক ইবনে মিগওয়াল, আওযাঈ, রবীআ ইবনে সালেহ, বুকাইর, আবু ইউসুফ, সুফিয়ান সাওরী, কায়েস ইবনূর রবী, উমার ইবনে যার, মিসআর ইবনে কুদামা প্রমুখ মনীষীদের নিকট থেকেও হাদীসের সনদ লাভ করেন। তিনি সিরিয়ায় ইমাম আওযাঈর কাছে এবং মদীনায় ইমাম মালেকের কাছে (তিন বছর) হাদীসের জ্ঞান লাভ করেন। তার নিকট থেকে ইমাম শাফিঈ, আবু সুলায়মান মূসা ইবনে সুলায়মান, হিশাম ইবনে উবায়দুল্লাহ আল-রাযী, আবু উবায়েদ কাসেম ইবনে সাল্লাম, আলী ইবনে মুসলিম আল-তাওসী, আবু হাফস আল-বুকাইর এবং খালাফ ইবনে আইউব হাদীস বর্ণনা করেন (তাজীলুল মুনফিআহ এবং মুওয়াত্তার ভূমিকা)।
ইমাম আবু হানীফা (র)-এর ইন্তেকালের পর তিনি ইমাম আবু ইউসুফের সাহচর্যে থেকে ইলমে ফিক্হের চর্চা করেন (যাহাবী)। ইবনে হাজারের মতে, তিনি অসাধারণ মেধাশক্তির অধিকারী ছিলেন (আল-ইছার বি-মারিফাতি রুয়াতিল আছার)। ইলমে হাদীসেও তিনি বিশেষ দক্ষতা অর্জন করেন। হানাফী ইমামদের সাথে চরম মতবিরোধ সত্ত্বেও ইমাম দারু কুতনী অকপটে একথা স্বীকার করেন যে, তিনি সিকাহ (নির্ভরযোগ্য) রাবী এবং হাদীসের হাফেজদের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন (হাফেজ যায়লাঈর 'তাখরীজ আহাদীসিল হিদায়া', ১খ, ৪০৮-৯)। হাফেজ আলী ইবনুল মাদীনী তাকে ন্যায়নিষ্ঠ ও সত্যবাদী (صدوق) বলে মন্তব্য করেন (আল-ইছার)। হাফেজ যাহাবী তার ‘মীযানুল ইতিদাল' গ্রন্থে লিখেছেন, وكان من بحور العلم والفقه (তিনি ছিলেন জ্ঞান ও ফিকহের মহাসমুদ্র)। যাহাবী আরো বলেন, ইমাম শাফিঈ তার কাছ থেকে হাদীসের হুজ্জাত গ্রহণ করেন (মানাবিক)। হাফেয ইবনে হাজার বলেন, ইমাম শাফিঈ ও ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বল জ্ঞান-গরিমার দিক থেকে তাকে সমীহ করতেন (তাজীল)।
ইয়াহ্ইয়া ইবনে সালেহ (র) বলেন, আমাকে ইবনে আকসাম বললো, আপনি ইমাম মালেককে দেখেছেন, তার কাছে শুনেছেন এবং মুহাম্মাদের সাহচর্যেও থেকেছেন। এই দুই মনীষীর মধ্যে কে অধিক জ্ঞানী ছিলেন? আমি বললাম, ইমাম মুহাম্মাদ ইমাম মালেকের তুলনায় অধিক জ্ঞানী ছিলেন। আবু উবায়েদ (র) বলেন, আমি আল্লাহর কিতাব সম্পর্কে ইমাম মুহাম্মাদের চেয়ে অধিক জ্ঞানী লোক আর দেখিনি।
ইমাম শাফিঈ (র) বলেন, আমি যদি বলতাম – কুরআন মজীদ ইমাম মুহাম্মাদের ভাষায় নাযিল হয়েছে—তবে তার ভাষার অলংকরণের কারণেই তা বলতাম। আমি যখন তাকে কুরআন পড়তে শুনতাম, মনে হতো তা যেন তার ভাষায় নাযিল হচ্ছে। আমি তার চেয়ে অধিক প্রজ্ঞাবান ব্যক্তি আর দেখিনি। তিনি যখন মাসআলা-মাসায়েল বের করতেন——মনে হতো তার উপর যেন কুরআন নাযিল হচ্ছে। একটি শব্দও আগে-পিছে হতো না। ফিক্হের জ্ঞানের ব্যাপারে তিনি আমার উপর অজস্র অনুগ্রহ করেছেন (ইমাম মুহাম্মাদের কিতাবুল আসল-এর ভূমিকা, সামআনীর আল-আনসাব)।
ইবরাহীম হারবী ইমাম আহমাদকে জিজ্ঞেস করলেন, আপনি এসব কঠিন মাসআলার সমাধান কোথায় পেলেন? তিনি বলেন, ইমাম মুহাম্মাদের গ্রন্থসমূহে (ভূমিকা)।
মুজাশে ইবনে ইউসুফ (مجاشع بن يوسف) বলেন, একদা আমি মদীনায় ইমাম মালেকের দরবারে উপস্থিত ছিলাম। তিনি লোকদের বিভিন্ন বিষয়ে ফতোয়া দিচ্ছিলেন। এমন সময় সেখানে ইমাম আবু হানীফার যুবক সাথী মুহাম্মাদ ইবনুল হাসান উপস্থিত হয়ে তাকে বলেন, সহবাস জনিত কারণে নাপাক ব্যক্তি বাইরে কোথাও পানি পাচ্ছে না। কিন্তু মসজিদের ভিতরে পানি আছে। এমতাবস্থায় সে কি করবে? ইমাম মালেক (র) বলেন, সহবাস জনিত কারণে নাপাক ব্যক্তি মসজিদে প্রবেশ করবে না। মুহাম্মাদ (র) বলেন, এদিকে নামাযের ওয়াক্তও হয়ে গেছে এবং সে পানিও দেখতে পাচ্ছে—এখন সে কি করবে? ইমাম সাহেব বরাবর বলতে থাকলেন, না সে মসজিদে প্রবেশ করবে না। কিন্তু যুবক মুহাম্মাদও বরাবর একই প্রশ্ন করতে থাকলে ইমাম সাহেব বলেন, তাহলে তুমিই বলো, সে কি করবে? যুবক বলেন, সে তাইয়াম্মুম করে মসজিদে প্রবেশ করবে, অতঃপর পানি নিয়ে এসে গোসল করবে। মালেক (র) বলেন, তুমি কোথায় থাকো? মুহাম্মাদ (র) বলেন, এখানে (তিনি জমীনের দিকে ইংগিত করলেন)। তিনি বলেন, না তো! মদীনায় এমন কোন লোক নেই যাকে আমি চিনি না। মুহাম্মাদ (র) বলেন, আপনি যাদের চেনেন তাদের সংখ্যা খুব বেশী নয়।
লোকেরা ইমাম সাহেবকে বললো, ইনি ইমাম আবু হানীফার সাথী মুহাম্মাদ ইবনুল হাসান। তিনি বলেন, মুহাম্মাদ ইবনুল হাসান কি করে মিথ্যা কথা বলতে পারে? অথচ সে বলেছে যে, সে মদীনার অধিবাসী। লোকেরা বললো, তিনি তো এখানকার অধিবাসী বলে মাটির দিকে ইংগিত করেছেন। ইমাম সাহেব বলেন, ব্যাপারটি আমার কাছে আগেরটির চেয়ে অত্যন্ত দুরুহ মনে হলো (ভূমিকা)।
উল্লেখিত মন্তব্য ও ঘটনা থেকে ইমাম মুহাম্মাদের জ্ঞান-গরিমা ও প্রজ্ঞার পরিচয় পাওয়া যায়। তিনি ছিলেন অত্যন্ত সাহসী ও নির্ভীক প্রকৃতির লোক। একবার খলীফা হারুনুর রশীদের আগমনে উপস্থিত সকলেই দাঁড়িয়ে তাকে সম্মান প্রদর্শন করে। কিন্তু ইমাম মুহাম্মাদ পূর্ববৎ বসেই থাকলেন। পরে হারুনুর রশীদ তাকে ডেকে এনে না দাঁড়ানোর কারণ জিজ্ঞেস করেন। তিনি বলেন, প্রশাসকের আগমনে আলেম ব্যক্তি উঠে দাঁড়িয়ে সম্মান করলে তা জ্ঞানেরই অমর্যাদা করা হয়। তাছাড়া রাসূলুল্লাহ (সাঃ) কোন ব্যক্তির আগমন উপলক্ষে বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে সম্মান প্রদর্শন করতে নিষেধ করেছেন। আমি তাঁর সুন্নাতের উপর আমল করেছি (ভূমিকা)।
হারূনুর রশীদ তাকে রিক্কার (الرقة) প্রধান বিচারপতি নিয়োগ করেন। এখানে অবস্থানকালে তিনি একটি গ্রন্থ প্রণয়ন করেন। তার নামকরণ করেন الرقيات (আর-রুকিয়াত)। পরে তাকে এ পদ থেকে বরখাস্ত করা হয় এবং তিনি বাগদাদে ফিরে আসেন। হারুনুর রশীদ যখন রায় (الرى) এলাকা যান, তখন তার সাথে ইমাম মুহাম্মাদ (র) এবং ইমাম কিসাঈও (الكسائى) ছিলেন। তারা উভয়ে একই দিন ইন্তেকাল করেন। দাফনের কাজ সম্পন্ন করে হারুনুর রশীদ ইমাম মুহাম্মাদ (র) সম্পর্কে মন্তব্য করেন, আজকে আমরা আরবী ভাষা ও ফিক্হ মাটির নিচে দাফন করলাম। ইমাম সাহেব ১৮৯ হিজরীতে (৮০৪ খৃ.) ৫৭ বা ৫৮ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন। তার রচিত গ্রন্থসমূহের একটি তালিকা নিম্নে দেয়া হলোঃ
(১) المبسوط যা كتاب الاصل নামে পরিচিত এবং কয়েক খণ্ডে বিভক্ত; (২) الزيادات (৩) الجامع الصغير (৪) الجامع الكبير (৫) السير الصغير (৬) السير الكبير (এই ছ'টি গ্রন্থকে একত্রে الظاهر الرواية বলা হয়); (৭) المحيط (৮) النوادر (৯)الهارونيات
কাযী মাহমূদ আল-আইনী বলেন, হিদায়া গ্রন্থ মূলত ইমাম মুহাম্মাদের 'আল-জামে আস-সপীর’ এবং আবুল হাসানের 'আল-মুখতাসার ফিল-ফিক্হ' (আল-কুদূরী) গ্রন্থের বিস্তারিত রূপ। কথিত আছে, তিনি দৈনিক দশ পারা কুরআন পাঠ করতেন এবং বিশ বছর বয়স থেকে কুফার জামে মসজিদে নিয়মিত ওয়াজ-নসীহত করতেন। তিনি যখন হাদীসের দরস দিতেন, তার বাড়ি লোকে লোকারণ্য হয়ে যেতো। মুহাদ্দিস হাকেম নায়শাপুরী তাকে তাবাউ তাবিঈন (تبع تابعين) বলে উল্লেখ করেছেন ।
মুওয়াত্তা ইমাম মুহাম্মাদ (র)
ইমাম মুহাম্মাদের আল-মুওয়াত্তা মূলত ইমাম মালেকের (জন্ম ৯৫ হি.) আল-মুওয়াত্তার প্রতিলিপি। ইমাম মালেকের নিকট অসংখ্য মুহাদ্দিস ও ফিক্হবিদ হাদীসের শিক্ষা লাভ করেন এবং তারা নিজস্বভাবে এর সংকলনও তৈরি করেন। কিন্তু ইলমী দুনিয়ায় তাদের কারো সংকলনেরই অনুসন্ধান পাওয়া যাচ্ছে না। কেবল তার দুই প্রখ্যাত ছাত্র ইমাম মুহাম্মাদ ইবনুল হাসান এবং ইয়াহইয়া ইবনে ইয়াহ্ইয়া আন্দালুসীর (মৃ. ১৩৪ হি.) সংকলন দু'টিই আজ পর্যন্ত বর্তমান আছে। ইমাম ইয়াহ্ইয়ার সংকলনটিই "মুওয়াত্তা ইমাম মালেক" নামে এবং মুহাম্মাদ ইবনুল হাসানের সংকলনটি “মুওয়াত্তা ইমাম মুহাম্মাদ" নামে পরিচিত। “মুওয়াত্তা ইমাম মালেক" বলতেই আমাদের দৃষ্টি যে কিতাবের দিকে চলে যায় তা হচ্ছে ইয়াহ্ইয়ার এই সংকলন যা কোন কোন মনীষীর মতে اصح الكتب بعد كتاب الله (আল্লাহর কিতাবের পর সর্বাধিক সহীহ কিতাব)। দু'টি মুওয়াত্তাকে একই মায়ের দুই জমজ সন্তান বললে অত্যুক্তি হবে না।
নামকরণ
ইমাম মালেক (র) যেসব হাদীস ও আছার (সাহাবা ও তাবিঈদের বাণী) বর্ণনা করেছেন তা একত্রে সন্নিবেশিত করে মদীনার ৭০ জন ফকীহ আলেমের সামনে পেশ করেন। তারা সকলেই এ ব্যাপারে তার সাথে ঐক্যমত ব্যক্ত করেন। তাই তিনি এর নামকরণ করেন মুওয়াত্তা (موطأ)। অর্থাৎ সেই কিতাব যাকে সমতল করা হয়েছে এবং যার পরিশুদ্ধিকরণ করা হয়েছে। হাদীস বিশারদদের পরিভাষায় মুওয়াত্তাকে كتاب السنن বলা উচিৎ। কিন্তু এর মধ্যে যেহেতু সনদযুক্ত ও সনদবিহীন উভয় প্রকারের রিওয়ায়াত রয়েছে তাই শায়েখ ইবনুস সালাহ্ (ابن الصلاح) মুওয়াত্তাকে كتاب الجوامع-এর অন্তর্ভুক্ত করেছেন। ইমাম মালেকের এই পাণ্ডুলিপির ভিত্তিতেই ইয়াহইয়া আন্দালুসী ও মুহাম্মাদ শারবানী নিজ নিজ সংকদন প্রস্তুত করেন।
দু'টি সংকলনের মধ্যে পার্থক্য
ইমাম ইয়াহ্ইয়ার সংকলনে প্রতিটি রিওয়ায়াত عن مالك (মালেকের সূত্রে) বলে শুরু হয়েছে। কিন্তু তিনি গোটা মুওয়াত্তা তার কাছে শুনতে পাননি। কারণ তিনি যে বছর তার সাহচর্যে আসেন সেই বছরই ইমাম সাহেব ইন্তেকাল করেন (১৭৯ হি.)। এজন্য তিনি মুওয়াত্তার কতিপয় অনুচ্ছেদ মালেকের অপর ছাত্র বিয়াদের কাছে শুনেন এবং তার বর্ণনা এভাবে শুরু করেছেন حدثنى زياد عن مالك (যিয়াদ আমাকে মালেকের সূত্রে বলেছেন)। কিন্তু ইমাম মুহাম্মাদ (র) পূর্ণ তিন বছর তার সাহচর্য লাভ করেন এবং ইমাম সাহেব তাকে গোটা মুওয়াত্তা পড়ে শুনান। এটা ছিল ইমাম সাহেবের দরবারের একটা ব্যতিক্রম। কারণ ছাত্ররা তাকেই পাঠ করে শুনাতো, কিন্তু মুহাম্মাদের বেলায় তিনি নিজেই পাঠ করে শুনান। তিনি মালেকের কাছে প্রায় সাত শত হাদীস শুনেন।
ইয়াহ্ইয়ার সংকলনে অনেক অনুচ্ছেদে কোন হাদীসের উল্লেখ নেই, শুধু ইমাম মালেকের ইজতিহাদী মাসআলা বর্ণিত হয়েছে। কিন্তু মুহাম্মাদের সংকলনের প্রতিটি অনুচ্ছেদে হাদীস অথবা আছার বিদ্যমান রয়েছে। অনন্তর ইয়াহ্ইয়ার সংকলনে কেবল মালেকের রিওয়ায়াতই স্থান পেয়েছে। কিন্তু মুহাম্মাদের সংকলনে অন্য শায়েখদের রিওয়ারাতও অন্তর্ভুক্ত আছে। এতে ইখতিলাফী মাসআলার ক্ষেত্রে উভয় পক্ষের দলীল আনা হয়েছে এবং এর তুলনামূলক আলোচনা করা হয়েছে। কিন্তু ইয়াহ্ইয়ার সংকলনে তা নেই। তবে তার সংকলনের চর্চা ব্যাপক এবং বহুল বিস্তারিত।
ইমাম মুহাম্মাদের মুওয়াত্তার বিন্যাস পদ্ধতি
অনুচ্ছেদে (ترجمة الباب) তিনি সর্বপ্রথম ইমাম মালেকের রিওয়ায়াত এনেছেন, অতঃপর وبهذا نأخذ ( আমরা এমত গ্রহণ করেছি) বলে উল্লেখিত রিওয়ায়াতের উপর আমল করার কথা বলে তার ব্যাখ্যা প্রদান করেছেন। আবার কখনো অতটুকু কথা বলে দেয়াই যথেষ্ট মনে করেছেন। আর ভিন্নমত পোষণ করার ক্ষেত্রে অপরাপর রাবীর বর্ণিত হাদীস পেশ করে তিনি ইমাম মালেকের রিওয়ায়াতের উপর আমল না করার কারণ বলে দিয়েছেন।
প্রতিটি মাসআলার ক্ষেত্রে তিনি ইমাম আবু হানীফার অভিমত অপরিহার্যরূপে উল্লেখ করেছেন। প্রয়োজনবোধে তার মত উল্লেখ করার পর এও বলে দিয়েছেন যে, والعامة من فقهائنا (আমাদের ফিক্হবিদ সাধারণেরও এই মত)। এখানে ফুকাহা বলতে ইরাকের ফিক্হবিদ এবং العامة বলতে তাদের অধিকাংশের মতকে বুঝিয়েছেন, আবার কোথাও তিনি কেবল ইবরাহীম নাখাঈর মত উল্লেখ করেছেন, কোথাও ইমাম আবু হানীফার মত নকল করার সাথে সাথে ইমাম মালেক ও অপরাপর ইমামের যতও উল্লেখ করেছেন। তিনি কোথাও আবু হানীফার রায়ের সাথে একমত না হতে পারলে তার কারণও বর্ণনা করেছেন।
ইমাম মুহাম্মাদ (র) এই কিতাবের কোথাও কোথাও هذا جميل এবং هذا حسن ইত্যাদি পরিভাষা ব্যবহার করেছেন। এর দ্বারা তিনি মুস্তাহাব পর্যায়ের আমল বুঝাননি, বরং তা যে ওয়াজিব পর্যায়ের আমল নয় তা বুঝিয়েছেন। তা সুন্নাতে মুয়াক্কাদাও হতে পারে বা অ-মুয়াক্কাদাও হতে পারে। আমরা এর অর্থ নিয়েছি 'উত্তম' 'ভালো' ইত্যাদি। অনুরূপভাবে لا باس বলতে তিনি কোন কাজ করা যে জায়েয তা বুঝিয়েছেন, মাকরূহ বুঝাননি। আমরা এর অর্থ করেছি 'এতে কোন দোষ নেই'। অনন্তর তিনি ينبغى শব্দটি কোন কাজ ওয়াজিব বা সুন্নাতে মুয়াক্কাদা বুঝানোর জন্য ব্যবহার করেছেন। আমরা এর অর্থ করেছি “উচিৎ”। তিনি اثار শব্দটি মারফু, মাওকূফ ও মাকতু সব ধরনের রিওয়ায়াত বুঝানোর জন্য ব্যবহার করেছেন।
ইমাম মুহাম্মাদের মুওয়াত্তায় মোট ১১৮০টি রিওয়ায়াত রয়েছে। এর মধ্যে মারফু, মাওকূফ প্রায় সব ধরনের বর্ণনাই আছে। এর মধ্যে ইমাম মালেকের ১,০০৫টি এবং অবশিষ্টদের ১৭৫টি রিওয়ায়াত রয়েছে। তিনি ইমাম আবু হানীফার সূত্রে ১৩টি এবং ইমাম আবু ইউসুফের সূত্রে ৪টি রিওয়ায়াত নিয়েছেন। এতে কোন মাওদু (জাল) হাদীস নেই। এতে কিছু যঈফ হাদীস থাকলেও তা ভিন্ন একাধিক সহীহ সূত্রে বর্ণিত হয়েছে।
ইমাম মুহাম্মাদের মুওয়াত্তার কয়েকটি শরাহ (ব্যাখ্যা) গ্রন্থও লেখা হয়েছে। যেমন :
১। মুল্লা আলী আল-কারী (মৃ.১০১৪ হি.)-র 'ফাতহুল মুগতিসা বি-শারহিল মুওয়াত্তা। এর হস্তলিখিত কপি ভারত ও পাকিস্তানের বিভিন্ন পাঠাগারে সংরক্ষিত আছে।
২। আল্লামা ইবরাহীম বীরীযাদা (মৃ. ১০৯৯ হি.)-র শরাহ বিরাট দুই খণ্ডে বিভক্ত। এর কপি ইস্তাম্বুলের পাঠাগারে সংরক্ষিত আছে।
৩। মাওলানা আবদুল হাই লাখনবী (মৃ. ১৩০৪ হি.)-র শরাহ 'আত-তালীকুল মুমাজ্জাদ আলা মুওয়াত্তা ইমাম মুহাম্মাদ। এর কয়েক সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছে।
৪। হাফেজ কাসিম ইবনে কুতলুবুগা (মৃ. ৮৭৯ হি.) মুওয়াত্তার রাবীদের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি সম্বলিত একটি স্বতন্ত্র গ্রন্থ প্রণয়ন করেন।
হাদীসের পরিচয়
শাব্দিক অর্থে হাদীস (حديث) মানে নতুন, প্রাচীন ও পুরাতন-এর বিপরীত বিষয়। এ অর্থে যে সব কথা, কাজ ও বস্তু পূর্বে ছিল না, এখন অস্তিত্ব লাভ করেছে—তাই হাদীসের আরেক অর্থ হলো কথা।
ফকীহ গণের পরিভাষায় নবী করীম (সা) আল্লাহর রাসূল হিসাবে যা কিছু বলেছেন, যা কিছু করেছেন এবং যা কিছু বলার বা করার অনুমতি দিয়েছেন অথবা সমর্থন জানিয়েছেন তাকে হাদীস বলা হয়। কিন্তু মুহাদ্দিসগণ এর সঙ্গে রাসূলূল্লাহ (সা) সম্পর্কিত বর্ণনা ও তাঁর গুণাবলী সম্পর্কিত বিবরণকেও হাদীসের অন্তর্ভুক্ত করেন।
এ হিসাবে হাদীসকে প্রাথমিক পর্যায়ে তিন শ্রেণীতে ভাগ করা যাযঃ কাওলী হাদীস, ফে'লী হাদীস ও তাকরীরী হাদীস।
প্রথমত, কোন বিষয়ে রাসূলুল্লাহ্ (সা) যা বলেছেন, অর্থাৎ যে হাদীসে তাঁর কোন কথা বিস্তৃত হয়েছে তাকে কাওলী (বাণী সম্পর্কিত) হাদীস বলা হয়।
দ্বিতীয়ত, মহানবী (সা)-এর কাজকর্ম, চরিত্র ও আচার আচরণের ভেতর দিয়েই ইসলামের যাবতীয় বিধি-বিধান ও রীতিনীতি পরিস্ফুট হয়েছে। অতএব যে হাদীসে তাঁর কোন কাজের বিবরণ উল্লিখিত হয়েছে তাকে ফে'লী (কর্ম সম্পর্কিত) হাদীস বলা হয়।
তৃতীয়ত, সাহাবীগণের যে সব কথা বা কাজ নবী করীম (সা)-এর অনুমোদন ও সমর্থনপ্রাপ্ত হয়েছে, সে ধরনের কোন কথা বা কাজের বিবরণ হতেও শরী'আতের দৃষ্টিভঙ্গি জানা যায়। অতএব যে হাদীসে এ ধরনের কোন ঘটনার বা কাজের উল্লেখ পাওয়া যায় তাকে তাকরীরী (সমর্থনমূলক) হাদীস বলে ।।
হাদীসের অপর নাম সুন্নাহ্ (سنة) সুন্নত শব্দের অর্থ চলার পথ, কর্মের নীতি ও পদ্ধতি। যে পন্থা ও রীতি নবী করীম (সা) অবলম্বন করতেন তাকে সুন্নাত বলা হয়। অন্য কথায় রাসূলুল্লাহ (সা) প্রচারিত উচ্চতম আদর্শই সুন্নত।
কুরআন মজীদে মহোত্তম ও সুন্দরতম আদর্শ (3) বলতে এই সুন্নাতকেই বোঝানো হয়েছে। ফিকহের পরিভাষায় সুন্নাত বলতে ফরয ও ওয়াজিব ব্যতীত ইবাদত রূপে যা করা হয় তা বোঝায়, যেমন সুন্নাত নামায। হাদীসকে আরবী ভাষায় খবর (خبر) ও বলা হয়। তবে খবর শব্দটি হাদীস ও ইতিহাস উভয়টিকেই বোঝায়।
আসার (آثار) শব্দটিও কখনও কখনও রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর হাদীস নির্দেশ করে। কিন্তু অনেকেই হাদীস ও আসার-এর মধ্যে কিছু পার্থক্য করে থাকেন। তাঁদের মতে সাহাবীগণ থেকে শরী আত সম্পর্কে যা কিছু উদ্ধৃত হয়েছে তাকে আসার বলে। তবে এ ব্যাপারে সবাই একমত যে, শরী'আত সম্পর্কে সাহাবীগণের নিজস্ব ভাবে কোন বিধান দেওয়ার প্রশ্নই উঠে না। কাজেই এ ব্যাপারে তাঁদের উদ্ধৃতিসমূহ মূলত রাসূলুল্লাহ (সা)-এর উদ্ধৃতি। কিন্তু কোন কারণে শুরুতে তাঁরা রাসূলুল্লাহ (সা)-এর নাম উল্লেখ করেন নি। উসূলে হাদীসের পরিভাষায় এসব আসারকে বলা হয় মাওকুফ হাদীস'।
ইলমে হাদীসের কতিপয় পরিভাষা
সাহাবী (صحابي): যে ব্যক্তি ঈমানের সঙ্গে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামের সাহচর্য লাভ করেছেন বা তাঁকে দেখেছেন ও তাঁর একটি হাদীস বর্ণনা করেছেন, অথবা জীবনে একবার তাঁকে দেখেছেন এবং ঈমানের সঙ্গে মৃত্যুবরণ করেছেন তাঁকে রাসূলুল্লাহ (সা)-এর সাহাবী বলে।
তাবিঈ (تابعي); যিনি রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর কোন সাহাবীর নিকট হাদীস শিক্ষা করেছেন অথবা অন্ততপক্ষে তাঁকে দেখেছেন এবং মুসলমান হিসাবে মৃত্যুবরণ করেছেন তাঁকে তাবিঈ বলে।
মুহাদ্দিস (محدث): যে ব্যক্তি হাদীস চর্চা করেন এবং বহু সংখ্যক হাদীসের সনদ ও মান সম্পর্কে বিশেষ জ্ঞান রাখেন তাঁকে মুহাদ্দিস বলে।
শায়খ (شيخ) হাদীসের শিক্ষাদাতা রাবীকে শায়খ বলে।
শায়খায়ন (شيخين) : সাহাবীগণের মধ্যে আবু বকর ও উমর (রা)-কে একত্রে শারখায়ন বলা হয়।
মুযতারাব (مضطرب) : যে হাদীসের রাবী হাদীসের মতন বা সনদকে বিভিন্ন প্রকারে বর্ণনা করেছেন সে হাসীসকে হাদীসে মুযতারাব বলা হয়। যে পর্যন্ত না এর কোনরূপ সমন্বয় সাধন সম্ভবপর হয়, সে পর্যন্ত এই সম্পর্কে অপেক্ষা করতে হবে অর্থাৎ এই ধরনের রিওয়ায়াত প্রমাণ হিসাবে ব্যবহার করা যাবে না।
মুদরাজ (مدرج) যে হাদীসের মধ্যে রাবী নিজের অথবা অপরের উক্তিকে অনুপ্রবেশ করিয়েছেন, সে হাদীসকে মুদরাজ এবং এইরূপ করাকে ইঁদরাজ বলা হয়। ইদরাজ করা হারাম। অবশ্য যদি এর দ্বারা কোন শব্দ বা বাক্যের অর্থ প্রকাশিত হয়, তবে দূষণীয় নয়।
মুত্তাসিল (متصل): যে হাদীসের সনদের ধারাবাহিকতা প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত পূর্ণরূপে রক্ষিত আছে, কোন স্তরেই কোন রাবীর নাম বাদ পড়েনি তাকে মুত্তাসিল হাদীস বলে।
মুনকাতি' (منقطع): যে হাদীসের সনদের ধারাবাহিকতা রক্ষিত হয়নি, মাঝখানে কোন এক স্তরে কোন এক বা একাধিক রাবীর নাম বাদ পড়েছে, তাকে মুনকাতি হাদীস বলে, আর এই বাদ পড়াকে ইনকিতা' বলা হয়।
মুরসাল (مرسل): যে হাদীসের সনদের ইনকিতা শেষের দিকে হয়েছে, অর্থাৎ সাহাবীর নাম বাদ পড়েছে এবং তাবিঈ সরাসরি রাসুলুল্লাহ (সা)-এর উল্লেখ করে হাদীস বর্ণনা করেছেন তাকে মুরসাল হাদীস বলা হয়।
মুতাবি' ও শাহিদ (متابع و شاهد) এক রাবীর হাদীসের অনুরূপ যদি অপর বাবীর কোন হাদীস পাওয়া যায় তবে দ্বিতীয় রাবীর হাদীসকে প্রথম রাবীর হাদীসের মুতাবি' বল হয়। যদি উভয় হাদীসের মূল রাবী অর্থাৎ সাহাবী একই ব্যক্তি হন। আর এইরূপ হওয়াকে মুতাবাআত বলে। যদি মূল রাবী একই ব্যক্তি না হন তবে দ্বিতীয় ব্যক্তির হাদীসকে শাহিদ বলে। আর এইরূপ হওয়াকে শাহাদত বলে। মুতাবা'আত ও শাহাদত দ্বারা প্রথম হাদীসটির শক্তি বৃদ্ধি পায়।
মু'আল্লাক (معلق) : সনদের ইনকিতা' প্রথম দিকে হলে, অর্থাৎ সাহাবীর পর এক বা একাধিক রাবীর নাম বাদ পড়লে তাকে মু'আল্লাক হাদীস বল হয়।
মারুফ ও মুনকার (المعروف و المنكر) : কোন দুর্বল রাবীর বর্ণিত হাদীস অপর কোন মকবুল (গ্রহণযোগা) রাবীর বর্ণিত হাদীসের বিরোধী হলে তাকে মুনকার বলা হয় এবং মকবুল রাবীর হাদীসকে মারুফ বলা হয়। মুনকার হাদীস গ্রহণযোগ্য নয়।
সাহীহ (صحيح) : যে হাদীসের সনদে উল্লেখিত প্রত্যেক রাবীই পূর্ণ আদালত ও যাবতা(ضبط)-গুণ সম্পন্ন এবং হাদীসটি যাবতীয় দোষত্রুটি মুক্ত তাকে সহীহ হাদীস বলে।
হাসান (حسن): যে হাদীসের কোন রাবীর যাব্ত গুণে পরিপূর্ণতার অভাব রয়েছে তাকে হাসান হাদীস বলা হয়। উম্মাহর ফিক্হবিদগণ সাধারণত সহীহ ও হাসান হাদীসের ভিত্তিতে শরী'আতের বিধান নির্ধারণ করেন।
যঈফ (ضعيف): যে হাদীসের রাবী কোন হাসান হাদীসের রাবীর গুণসম্পন্ন নন তাকে যঈফ হাদীস বলে।
কিছু বিষয়ে ‘যয়ীফ’ হাদীস বলা এবং আমল করাকে মুহাদ্দেসীনে কিরাম অনুমোদন করেছেন:
(১) কুরআনের ‘তাফসীর’ বা ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে,
(২) ইতিহাস বা ঐতিহাসিক বর্ণনার ক্ষেত্রে এবং
(৩) বিভিন্ন নেক আমলের ‘ফযীলত’-এর ক্ষেত্রে।
এক্ষেত্রে তাঁরা নিম্নরূপ শর্তগুলো উল্লেখ করেছেন।
(১) হাদীসটি ‘‘সাধারন দুর্বল’ হবে, হাদীসের দুর্বলতা যেন অধিক না হয়,যদ্দরুন সেটি মুনকার কিংবা জাল হবার পর্যায়ে পৌছে।
(২) যয়ীফ হাদীসটি এমন হতে হবে যেটি শরীয়তের কোন স্বীকৃত মুলনীতির আওতাধীন হবে।
(৩) যয়ীফ হাদীসকে রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর কথা বলে বিশ্বাস করা যাবে না। সাবধানতামূলকভাবে আমল করতে হবে।
আমল করার সময় এর সুপ্রমানিত হবার বিশ্বাস না করে বরং বর্ণিত ফজিলতের আশা করতঃ আমল করা। ইমাম ইবনে আব্দুল বার রহঃ (৪৬৩হি.)তার আত-তামহিদ গ্রন্থে (৬:৫৪-৫৫) একটি দুর্বল হাদীস উল্লেখ করে বলেন, হাদিসটি বাহ্যত সুন্দর হলেও (অর্থাৎ হাদিসটি দুর্বল)এর থেকে প্রাপ্ত বরকতের আশা করা যায়, ইনশাআল্লাহ।
অতএব, এ সব শর্তাদি অনুযায়ী হলে যঈফ হাদীস অবশ্যই আমলযোগ্য বিবেচিত হবে।
এবং এ বিষয়ে প্রতি যুগের বড় বড় হাদীস বিশারদগন একমত পোষন করেছেন।
সুতরাং, দুর্বলতার ধরন না জেনে ও তার তাহকীক না করে শুধু দুর্বলতা শুনেই ঢালাও ভাবে হাদীসকে যঈফ বলে পরিত্যাজ্য ঘোষণা দেওয়া উসুলে হাদীসের পরিপন্থী।
রাবীর দুর্বলতার কারণেই হাদীসকে দুর্বল বলা হয়, অন্যথায় নবী করীম (সা)-এর কোন কথাই যঈফ নয়।
মাওযূ' (موضوع): যে হাদীসের রাবী জীবনে কখনও ইচ্ছাকৃতভাবে রাসূলুল্লাহ (সা)-এর নামে মিথ্যা কথা রটনা করেছে বলে প্রমাণিত হয়েছে, তার বর্ণিত হাদীসকে মাওযূ' হাদীস বলে। এরূপ ব্যক্তির বর্ণিত হাদীস গ্রহণযোগ্য নয়।
মাতরূক (متروك): যে হাদীসের রাবী হাদীসের ক্ষেত্রে নয় বরং সাধারণ কাজে-কর্মে মিথ্যার আশ্রয় গ্রহণ করে বলে খ্যাত, তার বর্ণিত হাদীসকে মাতরূক হাদীস বলা হয়। এরূপ ব্যক্তির বর্ণিত হাদীসও
মুবহাম (مبهم) : যে হাদীসের রাবীর উত্তমরূপে পরিচয় পাওয়া যায় নি, যার ভিত্তিতে তার দোষগুণ বিচার করা যেতে পারে—এরূপ রাবীর বর্ণিত হাদীসকে মুবহাম হাদীস বলে। এই ব্যক্তি সাহাবী না হলে তার হাদীস ও গ্রহণযোগ্য নয়।
মুতাওয়াতির (متواتر): যে সাহীহ হাদীস প্রত্যেক যুগে এত অধিক লোক রিওয়ায়াত করেছেন যাদের পক্ষে মিথ্যার জন্য দলবদ্ধ হওয়া সাধারণত অসম্ভব তাকে মুতাওয়াতির হাদীস বলে। এই ধরনের হাদীস দ্বারা নিশ্চিত জ্ঞান (علم يقين) লাভ হয়।
খবরে ওয়াহিদ (خبر واحد) প্রত্যেক যুগে এক দুই অথবা তিনজন রাবী কর্তৃক বর্ণিত হাদীসকে খবরে ওয়াহিদ বা আখবারুল আহাদ বলা হয়।
এই হাদীস তিন প্রকারঃ
মাশহুর (المشهور) যে সাহীহ হাদীস প্রত্যেক যুগে অন্ততপক্ষে তিনজন রাবী বর্ণনা করেছেন তাকে মাশহুর হাদীস বলা হয়।
আযীয (العزيز): যে সাহীহ হাদীস প্রত্যেক যুগে অন্তত দুইজন রাবী বর্ণনা করেছেন তাকে আযীয বলে।
গরীব (الغريب) যে সাহীহ হাদীস কোন যুগে একজন মাত্র রাবী বর্ণনা করেছেন তাকে গরীর হাদীস বলা হয়।
হাদীসে কুদসী (الحديث القدسي) এ ধরনের হাদীসের মূলকথা সরাসরি আল্লাহর নিকট থেকে প্রাপ্ত এবং আল্লাহর সাথে সম্পর্কিত করে। যেমন আল্লাহ্ তাঁর নবী (সা)-কে ইলহাম কিংবা স্বপ্নযোগে অথবা জিবরাঈল (আ)-এর মাধ্যমে তা জানিয়ে দিয়েছেন, মহানবী (সা) তা নিজ ভাষায় বর্ণনা করেছেন।
মুত্তাফাক আলায়হী (متفق عليه): যে হাদীস একই সাহাবী থেকে ইমাম বুখারী ও ইমাম মুসলিম (র) উভয়ে গ্রহণ করেছেন, তাকে মুস্তাফাক আলায়হ হাদীস বলে।
আদালত (العدالة): যে সুদৃঢ় শক্তি মানুষকে তাকওয়া ও শিষ্টাচার অবলম্বনে এবং মিথ্যা আচরণ থেকে বিরত থাকতে উদ্বুদ্ধ করে তাকে আদালত বলে। এখানে তাকওয়া বলতে অশোভনীয় ও অভদ্রোচিত কার্য থেকে বিরত থাকা, যেমন হাট-বাজারে বা প্রকাশ্যে পানাহার করা বা রাস্তা-ঘাটে পেশাব-পায়খানা করা ইত্যাদি থেকে বিরত থাকাও বোঝায়।
যাবত (الضبط) : যে স্মৃতিশক্তি দ্বারা মানুষ শ্ৰুত বা লিখিত বিষয়কে বিস্তৃতি বা বিনাশ থেকে রক্ষা করতে সক্ষম হয় এবং যখন ইচ্ছা তা সঠিকভাবে স্মরণ করতে পারে তাকে যাবত বলা হয়।
ছিকাহ (ثقة) : যে রাবীর মধ্যে আদালত ও যাবত উভয় গুণ পূর্ণভাবে বিদ্যমান, তাকে ছিকাহ ছাবিত বা ছাবিত () বলা হয়।
হাদীস গ্রন্থসমূহের শ্রেণীবিভাগঃ
হাদীস গ্রন্থ প্রণয়নের বিভিন্ন ধরন ও পদ্ধতি রয়েছে। এসব গ্রন্থের নামও বিভিন্ন ধরনের। নিম্নে এর কতিপয় প্রসিদ্ধ পদ্ধতির নাম উল্লেখ করা হল :
১. আল-জামি' () : যে সব হাদীস গ্রন্থে (১) আকীদা-বিশ্বাস, (২) আহকাম (শরীআতের আদেশ-নিষেধ), (৩) আম্পাক ও আমার, (৪) কুরআনের তাফসীর, (৫) সীরাত ও ইতিহাস, (৬) ফিতন ও আশরাত অর্থাৎ বিশৃঙ্খলা ও আলামতে কিয়ামত, (৭) রিক্বাক্ব অর্থাৎ আত্মশুদ্ধি (৮) মানাকিব অর্থাৎ ফীলত ইত্যাদি সকল প্রকারের হাদীস বিভিন্ন অধ্যায়ে সন্নিবেশিত হয়, তাকে আল-জামি' বলা হয়। সাহীহ বুখারী ও জামি তিরমিযী এর অন্তর্ভুক্ত। সাহীহ মুসলিমে যেহেতু তাফসীর ও কিয়ামাত সংক্রান্ত হাদীস খুবই কম, তাই কোন কোন হাদীসবিশারদের মতে তা জামি শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত নয়।
২. আস-সুনান () যেসব হাদীসগ্রন্থে কেবলমাত্র শরী'আতের হুকুম-আহকাম ও ব্যবহারিক জীবনের জন্য প্রয়োজনীয় নিয়ম-নীতি ও আদেশ-নিষেধমূলক হাদীস একত্রিত করা হয় এবং ফিকহ গ্রন্থের ন্যায় বিভিন্ন অধ্যায় ও অনুচ্ছেদে সজ্জিত হয় তাকে সুনান বলে। যেমন সুনান আবু দাউদ, সুনান নাসাঈ, সুনান ইবন মাজা ইত্যাদি। তিরমিযী শরীফ ও এই হিসাবে সুনান গ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত।
৩. আল-মুসনাদ () : যে সব হাদীসগ্রন্থে সাহাবীগণের বর্ণিত হাদীসসমূহ তাঁদের নামের আদ্যাক্ষর অনুযায়ী অথবা তাঁদের মর্যাদা অনুযায়ী পরপর সংকলিত হয়, ফিকহের পদ্ধতিতে সংকলিত হয় না। তাকে আল-মুসনাদ বা আল-মাসানীদ () বলা হয়। যেমন হযরত আয়িশা (রা) কর্তৃক বর্ণিত সমস্ত হাদীস তাঁর নামের শিরোনামের অধীনে একত্রিত করা হলে। ইমাম আহমদ (র)-এর আল-মুসনাদ গ্রন্থ, মুসনাদ আবূ দাউদ তা'য়ালিসী (র) ইত্যাদি এই শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত।
৪. আল-মু'জাম (): যে হাদীসগ্রন্থে মুসনাদ গ্রন্থের পদ্ধতিতে এক একজন উত্তাদের নিকট থেকে প্রাপ্ত হাদীসসমূহ পর্যায়ক্রমে একত্রে সন্নিবেশ করা হয় তাকে আল-মু'জাম বলে। যেমন ইমাম তাবারানী (র) সংকলিত আল-মু'জামুল কারীর।
৫. আল-মুসতাদরাক () : যেসব হাদীস বিশেষ কোন হাদীস গ্রন্থে শামিল করা হয়নি অথচ তা সংশ্লিষ্ট গ্রন্থকারের অনুসৃত শর্তে পূর্ণমাত্রায় উত্তীর্ণ হয়, সে সব হাদীস যে গ্রন্থে সন্নিবেশ করা হয় তাকে আল-মুসতাদরাক বলা হয়। যেমন ইমাম হাকিম নিশাপুরী (র)-এর আল-মুসতাদরাক গ্রন্থ।
৬. রিসালা () যে ক্ষুদ্র কিতাবে মাত্র এক বিষয়ের অথবা এক রাবীর হাদীসসমূহ একত্র করা হয়েছে তাকে রিসালা বা জয় () বলা হয়।
৭. কুতুবে সিত্তাহ্ (الكتب الستة): বুখারী, মুসলিম, তিরমিযী, আবূ দাউদ, নাসাঈ ও ইবন মাজা-এই ছয়টি গ্রন্থকে একত্রে কুতুবে সিত্তাহ বলা হয়।
কিন্তু কতিপয় বিশিষ্ট আলিম ইবন মাজার পরিবর্তে ইমাম মালিক (র)-এর মুওয়াত্তাকে, আবার কিছু সংখ্যক আলিম সুনানুদ-দারিমীকে সিহাহ সিত্তার অন্তর্ভুক্ত করেছেন। শায়খ আবুল হাসান সিন্ধী (র) ইমাম তাহাবী (র) সংকলিত মা'আনীল আসার (তাবারী শরীফ) গ্রন্থকে কুতুবে সিত্তার অন্তর্ভুক্ত করেছেন। এমনকি ইবন হাযম ও আল্লামা আনওয়ার শাহ কাশ্মীরী (র) তাহাবী শরীফকে নাসায়ী ও আবু দাউদ শরীফের স্তরে গণ্য করেছেন।
সিহাহ সিত্তাহ না কুতুবে সিত্তাহ্, কোনটি সঠিকঃ
প্রসিদ্ধ ছয়টি হাদীসের কিতাবকে সিহাহ সিত্তাহ না বলে “কুতুবে সিত্তাহ “বা ছয়টি হাদীসের কিতাব নামে ডাকাই সঠিক এবং অধিক যুক্তিযুক্ত ও নিরাপদ।
সিহাহ সিত্তাহ অর্থ হল, ছয়টি সহীহ।
সিহাহ সিত্তাহ বলতে হাদীসের ছয়টি প্রসিদ্ধ সহীহ হাদীস সমৃদ্ধ কিতাবকে বুঝায়। যথা-১-সহীহ বুখারী। ২-সহীহ মুসলিম। ৩-সুনানে আবূ দাউদ। ৪-জামে তিরমিজী। ৫-সুনানে নাসায়ী। ৬-সুনানে ইবনে মাজাহ।
বুখারী মুসলিম ছাড়া বাকি চার কিতাবে কিছু দুর্বল হাদীসও রয়েছে। তবু অধিকাংশ হাদীস সহীহ হবার কারণে এ ছয় কিতাবকে “সিহাহ সিত্তাহ” হিসেবে ডাকা হয়ে থাকে।
প্রথম প্রথম “সিহাহ খামসা” পরিভাষাটি প্রসিদ্ধ ছিল। সেখানে ইবনে মাজাহ শামিল ছিল না। এ কারণেই ইমাম আবু বকর হাজেমী রহঃ “শুরূতুল আয়িম্মাতিল খামসা” নামে গ্রন্থ রচনা করেনন।
সর্বপ্রথম একসাথে এ ছয় কিতাবকে সিহাহ সিত্তাহ অভিহিত করে কিতাব লিখেছেন আবূ তাহের মাকদিসী। তার কিতাবের নাম হল “শুরূতুল আয়িম্মাতিস সিত্তাহ”।
তারপর আব্দুল গনী মাকদিসী রহঃ ও তার কিতাব “আলকামাল ফী আসমায়ির রিজাল” গ্রন্থে সিহাহ সিত্তাহ শব্দটি উক্ত ছয় কিতাবের ক্ষেত্রে ব্যবহার করেন।
কতিপয় মুহাদ্দিসীনে কেরাম ইবনে মাজাহ এর বদলে “মুয়াত্তা মালেক” কিতাবকে সিহাহ সিত্তার মাঝে শামিল করে থাকেন।
আবার কতিপয় “সুনানে দারামী” কিতাবকে সিহাহ সিত্তার মাঝে শামিল করে থাকেন।
তবে অবশেষে প্রসিদ্ধ ইবনে মাজাহ এরই হয়ে যায়।
একথা মনে রাখতে হবে যে, উপরোক্ত ছয় কিতাবেই সহীহ হাদীস আছে, এমন ধারণা করা গোমরাহী। কারণ, এ ছয় কিতাব ছাড়াও অনেক হাদীসের কিতাব রয়েছে যাতে অসংখ্য সহীহ হাদীসের ভান্ডার রয়েছে।
যেমন মুসনাদে আহমাদ, কিতাবুল আসার লিআবী ইউসুফ, তাহাবী শরীফ, সহীহ ইবনে খুজাইমা, সহীহ ইবনে হিব্বান, সুনানে দারামী, সুনানে দারা কুতনী, মুসনাদুল হুমাইদী, মুসনাদে ইবনুল জা’দ, শুয়াবুল ঈমান লিলবায়হাকী, সুনানুল কুবরা লিলবায়হকী, মুস্তাদরাক আলাস সহীহাইন ইত্যাদি।
এ কারণে প্রসিদ্ধ ছয়টি হাদীসের কিতাবকে সিহাহ সিত্তাহ না বলে “কুতুবে সিত্তাহ “বা ছয়টি হাদীসের কিতাব নামে ডাকাই অধিক যুক্তিযুক্ত ও নিরাপদ। যাতে করে অন্যান্য সহীহ হাদীসের কিতাবে পরোক্ষভাবে খাটো করা না হয়।
৮. সহীহায়ন (): সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিমকে একত্রে সাহীহায়ন বলা হয়।
৯. সুনানে আরবা'আ () : কুতুবে সিত্তার অপর চারটি গ্রন্থ--আবূ দাউদ, তিরমিযী, নাসাঈ এবং ইবন মাজাকে একত্রে সুনানে আরবা'আ বলা হয়।
সহীহায়নের বাইরেও সহীহ হাদীস রয়েছেঃ
বুখারী ও মুসলিম শরীফ সহীহ হাদীসের কিতাব। কিন্তু সমস্ত সহীহ হাদীসই যে বুখারী ও মুসলিমে রয়েছে তা নয়। ইমাম বুখারী (র) বলেছেনঃ 'আমি আমার এ কিতাবে সহীহ ব্যতীত কোন হাদীসকে স্থান দেই নাই এবং বহু সহীহ হাদীসকে আমি বাদও দিয়েছি।'
এইরূপে ইমাম মুসলিম (র) বলেনঃ 'আমি এ কথা বলি না যে, এর বাইরে যে সকল হাদীস রয়েছে সেগুলি সমস্ত যঈফ। কাজেই এ দুই কিতাবের বাইরেও সহীহ হাদীস ও সহীহ কিতাব রয়েছে।
বুখারী মুসলিম ছাড়াও সহীহ হাদীসের উপর অনেক হাদীস গ্রন্থ রচিত হয়েছে। বুখারী ও মুসলিমের মূলনীতি অনুপাতে যেসব হাদীস সহীহ এমন হাদীস যা ইমাম বুখারী ও মুসলিম আনেননি। কিন্তু তা বুখারী ও মুসলিমে আনা হাদীসের মতই সহীহ। এমন হাদীস একত্র করে “মুস্তাদরাক আলাস সহীহাইন” নামে আলাদা কিতাবও রচিত হয়েছে। যা এক সুবিশাল কিতাব। যে কিতাবে আট হাজার আটশত তিনটি হাদীস রয়েছে। যার কোনটিই বুখারী মুসলিমে বর্ণিত হয়নি।
এসব হাদীসকে সহীহ হওয়া থেকে বের করে দেয়া পাগলের প্রলাপ ছাড়া আর কী’ হতে পারে?
ইমাম বুখারী রহঃ নিজেই বলেছেনঃ
فَقَدْ رُوِّينَا عَنِ الْبُخَارِيِّ أَنَّهُ قَالَ: ” مَا أَدْخَلْتُ فِي كِتَابِي (الْجَامِعِ) إِلَّا مَا صَحَّ، وَتَرَكْتُ مِنَ الصِّحَاحِ لِحَالِ الطُّولِ
ইমাম বুখারী রহঃ থেকে বর্ণিত। তিনি বলেছেনঃ আমি আমার কিতাবে [সহীহ বুখারীতে] সহীহ হাদীস ছাড়া অন্য হাদীস আনিনি। কিন্তু আমি অনেক সহীহ হাদীস আমার কিতাবের কলেবর বড় হবার শংকায় বাদ দিয়েছি। [মুকাদ্দিমায়ে ইবনুস সালাহ-১/১৯]
ইমাম মুসলিম বলেছেনঃ
وَرُوِّينَا عَنْ مُسْلِمٍ أَنَّهُ قَالَ: ” لَيْسَ كُلُّ شَيْءٍ عِنْدِي صَحِيحٌ وَضَعْتُهُ هَاهُنَا – يَعْنِي فِي كِتَابِهِ الصَّحِيحِ –
ইমাম মুসলিম থেকে বর্ণিতঃ তিনি বলেছেনঃ আমার কাছে “সহীহ” হিসেবে গণ্য সব হাদীসই আমার কিতাবে আনিনি। [মুকাদ্দিমায়ে ইবনুস সালাহ-১/২০]
এ বিষয়ে ইবনুস সালাহ রহঃ এর বক্তব্যটি প্রণিধানযোগ্যঃ
وَقَدْ قَالَ الْبُخَارِيُّ: ” أَحْفَظُ مِائَةَ أَلْفِ حَدِيثٍ صَحِيحٍ، وَمِائَتَيْ أَلْفِ حَدِيثٍ غَيْرِ صَحِيحٍ “، وَجُمْلَةُ مَا فِي كِتَابِهِ الصَّحِيحِ سَبْعَةُ آلَافٍ وَمِائَتَانِ وَخَمْسَةٌ وَسَبْعُونَ حَدِيثًا بِالْأَحَادِيثِ الْمُتَكَرِّرَةِ. وَقَدْ قِيلَ: إِنَّهَا بِإِسْقَاطِ الْمُكَرَّرَةِ أَرْبَعَةُ آلَافِ حَدِيثٍ،
ইমাম বুখারী বলেছেনঃ আমার এক লাখ সহীহ হাদীস মুখস্ত। আর দুই লাখ গায়রে সহীহ হাদীস মুখস্ত।
অথচ সহীহ বুখারীতে তাকরার [এক বর্ণনা একাধিকবার উল্লেখকরণ]সহ মোট হাদীস সংখ্যা হল,সাত হাজার, দুইশত পঁচাত্তরটা। আর কেউ বলেছেনঃ তাকরার ছাড়া হাদীস সংখ্যা হল চার হাজার। [মুকাদ্দিমায়ে ইবনুস সালাহ-১/২০]
আর তালীক ও তাকরারসহ হাদীস সংখ্যা হল নয় হাজার বিরাশিটি।
এখন প্রশ্ন হল, ইমাম বুখারী রহঃ বলেছেন, তার সহীহ হাদীসই মুখস্ত ছিল এক লাখ। বুখারীতে উল্লেখ আছে মাত্র নয় হাজার। তাও তাকরারসহ। বাকি একান্নবই হাজার সহীহ হাদীস গেল কোথায়?
এ প্রশ্নের জবাব আমাদের কাছে আছে। আমাদের কথা হল,ইমাম বুখারী ও মুসলিম রহঃ তাদের কিতাবে সহীহ হাদীস এনেছেন কথা সত্য। কিন্তু সব হাদীস আনার দাবীও করেননি। আনতে পারেনওনি। তা সম্ভবও নয়। তাহলে কিতাব আরো বিশাল বড় হয়ে যেতো।
বাকি সহীহ হাদীসগুলো,মুস্তাদরাকে হাকেম, সহীহ ইবনে আওয়ানা, সুনানে দারা কুতনী, সহীহ ইবনে হিব্বান, সহীহ ইবনে খুজাইমা, সুনানে তিরমিজী,সুনানে আবু দাউদ, জামে তিরজিমী, সুনানে নাসায়ী,সুনানে ইবনে মাজাহ,মুসনাদুল হুমায়দী, মুসনাদুল বাজ্জার, মুসনাদে আহমাদ,সুনানে কুবরা লিলবায়হাকী,সুনানে সুগরা লিলবায়হাকী,শুয়াবুল ঈমান, তাহাবী শরীফ, মুসনাদে ইবনুল জা’দ ইত্যাদি হাদীসের কিতাবসমূহে রয়েছে।
এসব কিতাবের সব হাদীসই সহীহ নয়। কিছু হাদীস জঈফ বা জালও আছে। কিন্তু অধিকাংশ হাদীসই সহীহ কিংবা হাসান।
বিস্তারিত জানতে হলে পড়ুন-
মুকাদ্দিমায়ে ইবনুস সালাহ১/১৯-২২।
ফাতহুল মুগীছ বিশরহি আলফিয়াতিল হাদীস-১/৪৬-৪৭।
তাদরীবুর রাবী-১/১০৪।
ইমাম ইবনে কাছীর রহঃ বলেনঃ
ثم إن البخاري ومسلماً لم يلتزما بإخراج جميع ما يحكم بصحته من الأحاديث، فإنهما قد صححا أحاديث ليست في كتابيهما، كما ينقل الترمذي وغيره عن البخاري تصحيح أحاديث ليست عنده، بل في السنن وغيرها.
নিশ্চয় ইমাম বুখারী ও মুসলিম তারা সকল সহীহ হাদীসকে তাদের কিতাবে একত্র করাকে আবশ্যক করে নেননি। তারা উভয়ে এমন অনেক হাদীসকেই সহীহ বলেছেন, যা তাদের কিতাবে নেই। যেমন ইমাম বুখারী নিজেই সহীহ বলেছেন এমন অনেক হাদীস উল্লেখ করেছেন ইমাম তিরমিজী [ইমাম বুখারীর ছাত্র] ও অন্যান্য মুহাদ্দিসগণ।অথচ সেসব হাদীস ইমাম বুখারীর কিতাবে পাওয়া যায় না। বরং তা রয়েছে সুনান ও অন্যান্য গ্রন্থসমূহে।[ইখতিছারু উলুমিল হাদীস-১/২৫]
শায়খ আবদুল হক মুহাদ্দিস দেহলবীর (র) মতে সিহাহ সিত্তাহ, মুওয়াত্তা ইমাম মালিক ও সুনান দারিমী ব্যতীত নিম্নোক্ত কিতাবসমূহও সহীহ (যদিও বুখারী ও মুসলিমের পর্যায়ের নয়)।
১. সহীহ ইবন খুযায়মা আবূ আবদুল্লাহ মুহাম্মদ ইবন ইসহাক (৩১১ হি.)
২. সহীহ ইবন হিব্বান—আবূ হাতিম মুহাম্মাদ ইবন হিব্বান (৩৫৪ হি.) ৩. আল-মুস্তাদরাক হাকিম আবূ 'আবদুল্লাহ নিশাপুরী (৪০২ হি.)
৪. আল-মুখতারা—যিয়াউদ্দীন আল-মাকদিসী (৭০৪ হি.)
৫, সহীহ আবূ 'আ'ওয়ানা ইয়াকুব ইবন ইসহাক (৩১১ হি.
৬. আল-মুনতাকা—–—–ইবনুল জারূদ আবদুল্লাহ ইবন 'আলী।
এতদ্ব্যতীত আরো অনেক সহীহ কিতাব রয়েছে।
হাদীসের সংখ্যাঃ
হাদীসের মূল কিতাবসমূহের মধ্যে ইমাম আহমদ ইবন হাম্বলের 'মুসনাদ' একটি বৃহৎ কিতাব। এতে ৭ শত সাহাবী কর্তৃক বর্ণিত পুনরুল্লেখ (তাকরার) সহ মোট ৪০ হাজার এবং 'তাকরার' বাদে ৩০ হাজার হাদীস রয়েছে। শায়খ আলী মুত্তাকী জৌনপুরীর ৯৭৫হিঃ 'মুনতাখাবু কানযিল উম্মাল'-এ ৩০ হাজার এবং মূল কানযুল উম্মাল-এ (তাকরার বাদ) মোট ৩২ হাজার হাদীস রয়েছে।
অথচ এই কিতাব বহু মূল কিতাবের সমষ্টি। একমাত্র হাসান আহমদ সমরকান্দীর 'বাহরুল আসানীদ' কিতাবেই এক লক্ষ হাদীস রয়েছে বলে বর্ণিত আছে। মোট হাদীসের সংখ্যা সাহাবা ও তাবিঈনের আসারসহ সর্বমোট এক লক্ষের অধিক নয় বলে মনে করা হয়। এর মধ্যে সহীহ হাদীসের সংখ্যা আরো কম। হাকিম আবূ 'আবদুল্লাহ নিশাপুরীর মতে প্রথম শ্রেণীর সহীহ হাদীসের সংখ্যা ১০ হাজারেরও কম। সিহাহ সিত্তায় মাত্র পৌনে ছয় হাজার হাদীস রয়েছে। এর মধ্যে ২৩২৬টি হাদীস মুত্তাফাকু আলায়হি। তবে যে বলা হয়ে থাকে : হাদীসের বড় বড় ইমামের লক্ষ লক্ষ হাদীস জানা ছিল, তার অর্থ এই যে, অধিকাংশ হাদীসের বিভিন্ন সনদ রয়েছে। এমনকি শুধু নিয়্যাত সম্পর্কীয় () হাদীসটিরই ৭ শতের মত সনদ রয়েছে তাদবীন, ৫৪ পৃ.।
অথচ আমাদের মুহাদ্দিসগণ যে হাদীসের যতটি সনদ রয়েছে সেটিকে তত সংখ্যক হাদীস বলে গণ্য করেন।
হাদীসের সংকলন ও তার প্রচারঃ
সাহাবায়ে কিরাম (রা) মহানবী (সা)-এর প্রতিটি কথা মনোযোগ দিয়ে শুনতেন এবং তাঁর প্রতিটি কাজ ও আচরণ সূক্ষ্ম দৃষ্টিতে লক্ষ্য করতেন। রাসূলুল্লাহ (সা) সাহাবীগণকে ইসলামের আদর্শ ও এর যাবতীয় নির্দেশ যেমন মেনে চলার হুকুম দিতেন, তেমনি তা স্মরণ রাখতে এবং অনাগত মানব জাতির কাছে পৌঁছে দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। হাদীস চর্চাকারীর জন্য তিনি নিম্নোক্ত দু'আ করেছেন : نضر الله امرأ سمع منا حديثا فحفظه حتى يبلغه غيره الخ -
আল্লাহ্ সেই ব্যক্তিকে সজীব ও আলোকোজ্জ্বল করে রাখুন, যে আমার কথা শুনে স্মৃতিতে ধরে রাখল, তার পূর্ণ হিফাযত করল এবং এমন লোকের কাছে পৌঁছে দিল, যে তা শুনতে পায়নি।" (তিরমিযী, ২য় খণ্ড,
মহানবী (সা) আবদুল কায়েস গোত্রের প্রতিনিধি দলকে প্রয়োজনীয় উপদেশ দান করে বললেন : "এই কথাগুলো তোমরা পুরোপুরি স্বরণ রাখবে এবং যারা তোমাদের পেছনে রয়েছে তাদের কাছে পৌঁছে দেবে” (বুখারী)।
তিনি সাহাবীগণকে সম্বোধন করে বলেছেন: “আজ তোমরা (আমার নিকট দীনের কথা শুনছ, তোমাদের নিকট থেকেও (তা) শুনা হবে" (মুসতাদরাক হাকিম, ১, পৃ. ৯৫)।
তিনি আরও বলেন: আমার পরে লোকেরা তোমাদের নিকট হাদীস শুনতে চাইবে। তারা এই উদ্দেশ্যে তোমাদের নিকট এলে তাদের প্রতি সদয় হয়ো এবং তাদের নিকট হাদীস বর্ণনা করো।" (মুসনাদ আহমদ)।
তিনি অন্যত্র বলেছেন : আমার নিকট থেকে একটি বাকা হলেও তা অন্যের কাছে পৌঁছে দাও।" (বুখারী)
৮ম হিজরীতে মক্কা বিজয়ের পরের দিন এবং ১০ম হিজরীতে বিদায় হজ্জের ভাষণে মহানবী (সা) বলেন: "উপস্থিত লোকেরা যেন অনুপস্থিতদের নিকট আমার এ কথাগুলো পৌঁছে দেয়।" (বুখারী)
রাসূলুল্লাহ (সা)-এর উল্লিখিত বাণীর গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে তাঁর সাহাবীগণ হাদীস সংরক্ষণে উদ্যোগী হন।
প্রধানত তিনটি শক্তিশালী উপায়ে মহানবী (সা)-এর হাদীস সংরক্ষিত হয় (১) উম্মতের নিয়মিত আদল, (২) রাসূলুল্লাহ (সা)-এর লিখিত ফরমান, সাহাবীদের নিকট লিখিত আকারে সংরক্ষিত হাদীস ও পুস্তিকা এবং (৩) মুখস্থ করে স্মৃতির ভাণ্ডারে সঞ্চিত রাখা, অতঃপর বর্ণনা ও শিক্ষাদানের মাধ্যমে লোক পরস্পরায় তার প্রভাব।
তদানীন্তন আরবদের স্মরণশক্তি অসাধারণভাবে প্রখর ছিল। কোন কিছু স্মৃতিতে ধরে রাখার জন্য একবার প্রবণই তাদের জন্য যথেষ্ট ছিল। শক্তির সাহায্যে আরববাসীরা হাজার বছর ধরে তাদের জাতীয় ঐতিহ্যকে সংরক্ষণ করে আসছিল। স্থানীস সংরক্ষণের ক্ষেত্রে প্রাথমিক উপায় হিসাবে এই মাধ্যমটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। মহানবী (সা) যখনই কোন কথা বলতেন, উপস্থিত সাহাবীগণ পূর্ণ আগ্রহ ও আন্তরিকতা সহকারে তা শুনতেন, অতঃপর মুখস্থ করে নিতেন। তদানীন্তন মুসলিম সমাজে প্রায় এক লক্ষ লোক রাসুলুল্লাহ (সা)-এর বাণী ও কাজের বিবরণ সংরক্ষণ করেছেন এবং স্মৃতিপটে ধরে রেখেছেন। আবদুল্লাহ ইবন আব্বাস (রা) বলেন, “আমরা রাসুলুল্লাহ (সা)-এর হাদীস মুখস্থ করতাম (সহীহ মুসলিম, ভূমিকা,
উম্মতের নিরবচ্ছিন্ন আমল, পারস্পরিক পর্যালোচনা, শিক্ষাদানের মাধ্যমেও হাদীস সংরক্ষিত হয়। রাসূলুল্লাহ (সা) যে নির্দেশই নিতেন, সাহাবীগণ সাথে সাথে তা কার্যে পরিণত করতেন। তাঁরা মসজিদ অথবা কোন নির্দিষ্ট স্থানে একত্র হতেন এবং হাদীস আলোচনা করতেন। আনাস ইবন মালিক (রা) বলেন, “আমরা মহানবী (সা)-এর নিকট হাদীস শুনতাম। তিনি যখন মজলিস থেকে উঠে চলে যেতেন, আমরা শ্রুন্ড হাদীসগুলো পরস্পর পুনরাবৃত্তি ও পর্যালোচনা করতাম। আমাদের এক একজন করে সবাই হাদীসগুলি মুখস্থ শুনিয়ে দিতেন। এ ধরনের প্রায় বৈঠকেই অন্তত ষাট-সত্তরজন লোক উপস্থিত থাকতেন। বৈঠক থেকে আমরা যখন উঠে যেতাম তখন আমাদের প্রত্যেকেরই সবকিছু মুখস্থ হয়ে যেত” (আল-মাজমাউয যাওয়াইদ, ১৩, পৃ. ১৬১)।
মসজিদে নববীকে কেন্দ্র করে স্বয়ং নবী করীম (সা)-এর জীবদ্দশায় যে শিক্ষায়তন গড়ে উঠেছিল সেখানে একদল বিশিষ্ট সাহাবী (আহলুস সুফফা) সার্বক্ষণিকভাবে কুরআন-হাদীস শিক্ষায় রত থাকতেন। হাদীস সংরক্ষণের জন্য যথাসময়ে যথেষ্ট পরিমাণে লেখনী শক্তিরও সাহায্য নেয়া হয়। প্রাথমিক পর্যায়ে কুরআন মজীদ ব্যতীত সাধারণতঃ অন্য কিছু লিখে রাখা হত না। পরবর্তীকালে হাদীসের বিরাট সম্পদ লিপিবদ্ধ হতে থাকে।
'হাদীস নবী করীম (সা)-এর জীবদ্দশায় লিপিবদ্ধ হয়নি, বরং তাঁর ইন্তিকালের শতাব্দী কাল পর লিপিবন্ধ হয়েছে বলে যে ভুল ধারণা প্রচলিত আছে তার আদৌ কোন ভিত্তি নেই। অবশ্য একথা ঠিক যে, কুরআনের সঙ্গে হাদীস মিশ্রিত হয়ে জটিল পরিস্থিতির উদ্ভব হতে পারে—কেবল এই আশংকায় ইসলামী দাওয়াতের প্রাথমিক পর্যায়ে রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছিলেনঃ “আমার কোন কথাই লিখো না । কুরআন ব্যতীত আমার নিকট থেকে কেউ অন্য কিছু লিখে থাকলে তা যেন মুছে ফেলে।” (মুসলিম)।
কিন্তু যখন এরূপ বিভ্রান্তির আশঙ্কা ছিল না মহানবী (সা) তখন সে সকল ক্ষেত্রে হাদীস লিপিবদ্ধ করে রাখতে বিশেষভাবে উৎসাহিত করেন। আবদুল্লাহ ইবন অমির (রা) রাসূলুল্লাহ (সা)-এর নিকট উপস্থিত হয়ে বললেন, “হে আল্লাহর রাসূল! আমি হাদীস বর্ণনা করতে চাই। তাই যদি আপনি অনুমতি দেন, তাহলে আমি স্মরণশক্তির ব্যবহারের সাথে সাথে লেখনীরও সাহায্য গ্রহণ করতে ইচ্ছুক।" তিনি বললেন : আমার হাদীস কণ্ঠস্থ করার সাথে সাথে লিখেও রাখতে পার” (দারিমী)।
আবদুল্লাহ ইবন আমর (রা) আরও বলেন, “আমি রাসূলুল্লাহ (সা)-এর নিকট যা কিছু শুনতাম, মনে রাখার জন্য তা লিখে নিতাম। কতিপয় সাহাবী আমাকে তা লিখে রাখতে নিষেধ করলেন এবং বললেন, রাসূলুল্লাহ (সা) একজন মানুষ, কখনও স্বাভাবিক অবস্থায় আবার কখনও রাগান্বিত অবস্থায় কথা বলেন।" এ কথা বলার পর আমি হাদীস লেখা থেকে বিরত থাকলাম, অতঃপর তা রাসূলুল্লাহ (সা)-কে জানালাম। তিনি নিজ হাতের আঙ্গুলের সাহায্যে স্বীয় মুখের দিকে করে বললেন : “তুমি লিখে রাখ। সেই সত্তার কসম, যাঁর হাতে আমার প্রাণ, এই মুখ দিয়ে সত্য ছাড়া অন্য কিছু বের হয় না" (আবূ দাউদ, মুসনাদ আহমদ, দারিমী, হাকিম, বায়হাকী)।
তাঁর সংকলনের নাম ছিল “সহীফায়ে সাদিকা’। এ সম্পর্কে তিনি বলেন, “সাদিকা হাদীসের একটি সংকলন—যা আমি নবী (সা)-এর নিকট শুনেছি” –(উলূমুল হাদীস, পৃ. ৪৫)। এই সংকলনে এক হাজার হাদীস লিপিবদ্ধ ছিল।
আবূ হুরায়রা (রা) বলেন, এক আনসারী সাহাবী রাসূলুল্লাহ (সা)-এর কাছে আরয করলেন, হে আল্লাহর রাসূল! আপনি যা কিছু বলেন, আমার কাছে খুবই ভালো লাগে, কিন্তু মনে রাখতে পারি না। নবী করীম (সা) বললেন : “তুমি ডান হাতের সাহায্য নাও।" তারপর তিনি হাতের ইশারায় লিখে রাখার প্রতি ইঙ্গিত করলেন—–(তিরমিযী)।
আবূ হুরায়রা (রা) বলেন, মক্কা বিজয়ের দিন রাসূলুল্লাহ্ (সা) ভাষণ দিলেন। আবূ শাহ ইয়ামানী (র) আরয করলেন, হে আল্লাহর রাসূল! এ ভাষণ আমাকে লিখে দিন। নবী করীম (সা) ভাষণটি তাঁকে লিখে দেওয়ার নির্দেশ দেন—(বুখারী, তিরমিযী, মুসনাদে আহমদ)।
হাসান ইবন মুনাব্বিহ (র) বলেন, আবূ হুরায়রা (রা) আমাকে বিপুল সংখ্যক কিতাব (পাণ্ডুলিপি) দেখালেন। তাতে রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর হাদীস লিপিবদ্ধ ছিল (ফাতহুল বারী)। আবূ হুরায়রা (রা)-র সংকলনের একটি কপি (ইমাম ইবন তাইমিয়ার হস্তলিখিত) দামেশক এবং বার্লিনের লাইব্রেরীতে সংরক্ষিত আছে।
আনাস ইবন মালিক (রা) তাঁর (স্বহস্ত লিখিত) সংকলন বের করে ছাত্রদের দেখিয়ে বলেন, আমি এসব হাদীস নবী করীম (সা)-এর নিকট শুনে তা লিখে নিয়েছি। পরে তাঁকে তা পড়ে শুনিয়েছি (মুসতাদরাক হাকিম, ৩য় খ, পৃ. ৫৭৩)। রাফি' ইবন খাদীজ (রা)-কে স্বয়ং রাসূলুল্লাহ্ (সা) হাদীস লিখে রাখার অনুমতি দেন। তিনি প্রচুর হাদীস লিখে রাখেন (মুসনাদে আহমদ)। আলী ইবন আবূ তালিব (রা)-ও হাদীস লিখে রাখতেন। চামড়ার থলের মধ্যে রক্ষিত সংকলনটি তাঁর সঙ্গেই থাকত। তিনি বলতেন, আমি রাসূলুল্লাহ (সা)-এর নিকট থেকে এ সহীফা ও কুরআন মজীদ ব্যতীত আর কিছু লিখিনি। সংকলনটি স্বয়ং রাসূলুল্লাহ (সা) লিখিয়ে ছিলেন। এতে যাকাত, রক্তপণ (দিয়াত), বন্দীমুক্তি, মদীনার হেরেম এবং আরও অনেক বিষয় সম্পর্কিত বিধান উল্লেখ ছিল (বুখারী, ফাতহুল বারী)।
আবদুল্লাহ ইবন মাসউদ (রা)-এর পুত্র আবদুর রহমান একটি পাণ্ডুলিপি নিয়ে এসে শপথ করে বললেন, এটা ইবন মাসউদ (রা)-এর স্বহস্তে লিখিত (জামি' বায়ানিল ইলম, খ, পৃ. ১৭)।
স্বয়ং নবী করীম (সা) হিজরত করে মদীনায় পৌঁছে বিভিন্ন জাতির সমন্বয়ে যে চুক্তিপত্র সম্পাদন করেন (যা মদীনা সনদ নামে খ্যাত), হুদায়বিয়ার প্রান্তরে মক্কার মুশরিকদের সাথে যে সন্ধি করেন, বিভিন্ন সময়ে যে ফরমান জারি করেন, বিভিন্ন গোত্র-প্রধান ও রাজন্যবর্গের কাছে ইসলামের যে দাওয়াতনামা প্রেরণ করেন। এবং বিভিন্ন ব্যক্তি ও গোত্রকে যেসব জমি, ঘনি ও রূপ দান করেন তা সবই লিপিবদ্ধ আকারে ছিল এবং তা সবই হাদীসরূপে গণ্য।
এসব ঘটনা থেকে পরিষ্কারভাবে প্রমাণিত হয় যে, নবী (সা)-এর সময় থেকেই হাদীস লেখার কাজ শুরু হয়। তাঁর দরবারে বহু সংখ্যক লেখক সাহাবী সব সময় উপস্থিত থাকতেন এবং তাঁর মুখে যে কথাই শুনতেন, তা লিখে নিতেন। রাসূলুল্লাহ (সা)-এর আমলে অনেক সাহাবীর নিকট স্বহস্তে লিখিত সংকলন বর্তমান ছিল। উদাহরণস্বরূপ আবদুল্লাহ ইবন আমর (রা)-এর সহীফায়ে সাদিকা, আবূ হুরায়রা (রা)-র সংকলন সমধিক খ্যাত।
সাহাবীগণ যেভাবেই রাসূলুল্লাহ (সা)-এর নিকট থেকে হাদীসের জ্ঞান লাভ করেন তেমনিভাবে হাজার হাজার তাবিঈ সাহাবীগণের কাছে হাদীসের শিক্ষা লাভ করেন। একমাত্র আবূ হুরায়রা (রা)-র নিকট আটশত তাবিঈ হাদীস শিক্ষা করেন। সাঈদ ইবনুল মুসাইয়াব, উরওয়া ইবনু যুবাইর, ইমাম যুহরী, হাসান বসরী, ইবন সিরীন, নাফি, ইমাম যয়নুল আবিদীন, মুজাহিদ, কাযী শুরাইহ, মাসরুক, মাকহুল, ইকরিমা, আতা, কাতাদা, ইমাম শারী, আলতামা, ইবরাহীম নাম্বঈ (র) প্রমুখ প্রবীণ তাবিঈর প্রায় সকলে ১০ম হিজরীর পর জন্মগ্রহণ করেন এবং ১৪৮ হিজরীর মধ্যে ইন্তিকাল করেন। অন্যদিকে সাহাবীগণ ১১০ হিজরীর মধ্যে ইস্তিকাল করেন। এদিক থেকে বিচার করলে দেখা যায়, তাবিঈগণ সাহাবীগণের দীর্ঘ সাহচর্য লাভ করেন। একজন তাবিঈ বহু সংখ্যক সাহাবীর সঙ্গে সাক্ষাত করে নবী করীম (সা)-এর জীবনের ঘটনাবলী, তাঁর বাণী, কাজ ও সিদ্ধান্তসমূহ সংগ্রহ করেন এবং তা তাঁদের পরবর্তীগণ অর্থাৎ তাবে-তাবিঈনের নিকট পৌঁছে দেন।
হিজরী দ্বিতীয় শতকের শুরু থেকে কনিষ্ঠ তাবিঈ ও তাবিঈ-তাবিঈনের এক বিরাট দল সাহাবা ও প্রবীণ তাবিঈদের বর্ণিত ও লিখিত হাদীসগুলো ব্যাপকভাবে একত্র করতে থাকেন। তাঁরা গোটা মুসলিম জাহানে ছড়িয়ে পড়ে সমগ্র উম্মতের মধ্যে হাদীসের জ্ঞান পরিব্যাপ্ত করে দেন। এ সময় ইসলামী বিশ্বের খলীফা উমর ইবন আবদুল আযীয (র) দেশের বিভিন্ন এলাকার প্রশাসকদের নিকট হাদীস সংগ্রহ করার জন্য রাজকীয় ফরমান প্রেরণ করেন। ফলে সরকারী উদ্যোগে সংগৃহীত হাদীসের বিভিন্ন সংকলন রাজধানী দামেশক পৌঁছতে থাকে। খলীফা সেগুলোর একাধিক পাণ্ডুলিপি তৈরী করে দেশের সর্বত্র পাঠিয়ে দেন।
এ কালের ইমাম আবূ হানীফা (র)-এর নেতৃত্বে কুফায় এবং ইমাম মালিক (র) তাঁর মুওয়াত্তা গ্রন্থ এবং ইমাম আবূ হানীফার দুই সহচর ইমাম মুহাম্মদ ও আবূ ইউসুফ (র) ইমাম আবূ হানীফার রিওয়ায়াতগুলো একত্র করে
‘কিতাবুল আসার’ সংকলন করেন। এ যুগের আরও কয়েকটি উল্লেখযোগ্য হাদীস সংকলন হচ্ছে : জামি' সুফইয়ান সাওরী, জামি' ইবনুল মুবারক, জামি’ ইমাম আওযাঈ, জমি’ ইবন জুরাইজ ইত্যাদি।
হিজরী দ্বিতীয় শতকের শেষার্ধ থেকে চতুর্থ শতকের শেষ পর্যন্ত হাদীসের চর্চা আরও ব্যাপকতর হয়। এ সময়কালেই হাদীসের প্রসিদ্ধ ইমাম—বুখারী, মুসলিম, আবূ ঈসা ভিরমিযী, আবু দাউদ সিজিস্তানী, নাসাঈ ও ইবন মাজা (র)-এর আবির্ভাব হয় এবং তাঁদের অক্লান্ত পরিশ্রম ও দীর্ঘ অধ্যবসায়ের ফলশ্রুতিতে সর্বাধিক নির্ভরযোগ্য ছায়খানি হাদীস গ্রন্থ (সিহাহ সিত্তাহ) সংকলিত হয়। এ যুগেই ইমাম শাফিঈ (র) তাঁর কিতাবুল উম্ম ও ইমাম আহমদ (র) তাঁর আল-মুসনাদ গ্রন্থ সংকলন করেন। হিজরী চতুর্থ শতকে মুসতাদরাক হাকিম, সুনানু দারা কুতনী, সহীহ ইবন হিব্বান, সহীহ ইবন খুযায়মা, তাবারানীরআল-মু'জাম,মুসান্নাফুত-তাহাবী এবং আরও কতিপয় হাদীস গ্রন্থ সংকলিত হয়। ইমাম বায়হাকীর সুনানু কুবরা ৫ম হিজরী শতকে সংকলিত
হয়। চতুর্থ শতকের পর থেকে এ পর্যন্ত সংকলিত হাদীসের মৌলিক গ্রন্থগুলোকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন ধরনের সংকলন ও হাদীসের ভাষ্য গ্রন্থ এবং এই শাস্ত্রের শাখা-প্রশাখার উপর ব্যাপক গবেষণা ও বিভিন্ন গ্রন্থ রচিত হয়। বর্তমান কাল পর্যন্ত এ কাজ অব্যাহত রয়েছে। এসব সংকলনের মধ্যে তাজরীদুস সিহাহ ওয়াস্ সুনান, আত-তারগীব ওয়াত তারহীব, আল-মুহাল্লা, মাসাবীহুস সুন্নাহ, নাইলুল আওতার প্রভৃতি সমধিক প্রসিদ্ধ।
কূফা ; ইলমে হাদীসের চর্চাকেন্দ্র ও জ্ঞানের নগরীঃ
হযরত উমর রা. এর খিলাফতের সময় যখন কুফানগরীর গোড়াপত্তন হল তখন সে শহরের কুরআন-সুন্নাহর মুআল্লিম হিসেবে তিনি আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা.কেই নির্বাচন করেছিলেন এবং কুফার অধীবাসীদের উদ্দেশ্য করে ফরমান লিখেছিলেন, ‘আমি আম্মার রা.কে আমীর বানিয়ে এবং আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা.কে উযীর ও মুআল্লিম বানিয়ে তোমাদের কাছে প্রেরণ করছি। তাঁরা দুজনই বদর যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেছেন এবং তাঁরা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মর্যাদাপূর্ণ সাহাবীদের অন্তর্ভুক্ত। তাদের অনুগত থাকবে এবং তাদের অনুসরণ করবে। আব্দুল্লাহকে আমার প্রয়োজন ছিল, কিন্তু আমার প্রয়োজনের উপর আমি তোমাদের প্রয়োজনকে প্রাধান্য দিলাম।’
কুফা নগরীতে এসে আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. ইলমের যে ঝর্ণাধারা প্রবাহিত করেছেন এবং তাঁর উত্তরসুরীরূপে এমন এমন ব্যক্তিত্ব তৈরি করেছেন যার তুলনা সে সময়েও খুব বেশি ছিল না।
কুফা নগরীর আরো সৌভাগ্য যে, হযরত আলী রা.-এর খিলাফতের সময় তা ছিল ‘দারুল খিলাফাহ’ অর্থাৎ রাজধানী। আর আলী রা. সম্পর্কে বলা হয়েছে যে, ‘তিনি হলেন জ্ঞাননগরীর দ্বার।’ তাই তাঁর আগমন ইলমের কেন্দ্ররূপে এ নগরীকে আরো সমৃদ্ধ করেছিল। তবে এ নগরীতে কুরআন-সুন্নাহর ইলমের সূচনা ও বিকাশ যেসব সাহাবীদের মাধ্যমে হয়েছে তাদের মধ্যে শীর্ষ স্থানে ছিলেন হযরত অব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা.। কুফাবাসীদের ইলম ও ফযলের জন্য অন্যান্য সাহাবীও আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা.-এর অবস্থানকেই যথেষ্ট মনে করতেন। তারপরও কুফার আলিমগণের অভ্যাস ছিল তারা ইলমের অন্যান্য কেন্দ্রে সফর করে জ্ঞান-ভান্ডারকে সমৃদ্ধ করতেন।
আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা.-এর বিশিষ্ট শাগরিদ আলকামা রাহ. বলেন, আমি আবুদ্দারদা রা.-এর মজলিসে হাজির হলাম। তিনি আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, কোথা থেকে এসেছ? বললাম, কুফা থেকে। তিনি তখন বললেন, তোমাদের ওখানে কি ইবনে উম্মে আব্দ অবস্থান করছেন না, যিনি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বিছানা, মিসওয়াক ও পাদুকা বাহক, যিনি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের একান্ত বিষয়াদি সম্পর্কেও অবগত আর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পক্ষ থেকে শয়তানের হাত থেকে মুক্তি লাভের ঘোষণাপ্রাপ্ত? -সহীহ বুখারী ৭/৭১, ৭৩
হযরত আলী রা. যখন কুফায় আগমন করেন তখন আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা.-এর শাগরিদগণ ছিলেন নগরীর উস্তাদ ও মুআল্লিম। ইলমের প্রচারে-প্রসারে তাঁদের নিমগ্নতা দেখে হযরত আলী রা. বললেন, ‘ইবনে উম্মে আব্দ এঁদের কুফার বাতি বানিয়ে প্রস্থান করেছেন।’ -মানাকিবুল ইমামিল আযম, সদরুল আইম্মা মক্কী ২/১৪৩, ইমাম ইবনে মাজা আওর ইলমে হাদীস ২/৪০
ইমাম বুখারী বলেন,
قَالَ غُنْجَارٌ: وَحَدَّثَنَا مُحَمَّدُ بنُ عِمْرَانَ الجُرْجَانِيُّ، سَمِعْتُ عَبْدَ الرَّحْمَنِ بنَ مُحَمَّدٍ البُخَارِيَّ، سَمِعْتُ مُحَمَّدَ بنَ إِسْمَاعِيْلَ يَقُوْلُ: لَقِيْتُ أَكْثَرَ مِنْ أَلفِ رَجُلٍ أَهْلِ الحِجَازِ وَالعِرَاقِ وَالشَّامِ وَمِصْرَ، لَقِيتُهُم كَرَّاتٍ، أَهْلِ الشَّامِ وَمِصْرَ وَالجَزِيْرَةِ مرَّتينِ، وَأَهْلِ البَصْرَةِ أَرْبَعَ مَرَّاتٍ، وَبَالحِجَازِ سِتَّة أَعْوَامٍ، وَلاَ أُحْصِي كم دَخَلْتُ الكُوْفَةَ وَبَغْدَادَ مَعَ مُحَدِّثِي خُرَاسَانَ، مِنْهُمُ: المَكِّيُّ بنُ إِبْرَاهِيْمَ، وَيَحْيَى بنُ يَحْيَى، وَابْنُ شَقِيقٍ، وَقُتَيْبَةُ، وَشِهَابُ بنُ معمرٍ، وَبَالشَّامِ: الفِرْيَابِيُّ، وَأَبَا مُسْهِرٍ، وَأَبَا المُغِيْرَةِ، وَأَبَا اليَمَانِ، وَسَمَّى خلقاً. (سير أعلام النبلاء ط الرسالة (12/ 407)
যার মর্ম, কুফায় আমি কতবার এসেছি তাঁর ইয়ত্তা নেই।
হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. ; সাহাবায়ে কেরামের মাঝে কুরআন ও সুন্নাহের অন্যতম শ্রেষ্ঠ আলিমঃ
তাবেয়ী আবুল আহ্ওয়াস রহ. বলেন, আমি হযরত আবু মুসা আশআরী রা.-এর কাছে এলাম। সেখানে আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. ও আবু মাসউদ রা. উপস্থিত ছিলেন। তারা কুরআন মজীদ পড়ছিলেন। আমরা কিছুক্ষণ কথাবার্তা বললাম। ইতোমধ্যে আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. সেখান থেকে উঠে কোথাও গেলেন। আবু মাসউদ রা. তখন বললেন, ‘খোদার ক্বসম, যিনি এখন উঠে গেলেন তার চেয়ে বড় কুরআনের আলিম রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আর কাউকে রেখে গেছেন বলে আমার জানা নেই।’ -সহীহ মুসলিম
তাবেয়ী মাসরূক বলেন, আমি সাহাবীগণকে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করেছি। এরপর এ সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছি যে, তাঁদের সকলের ইলম ছ’জনের মধ্যে কেন্দ্রীভূত। তাঁরা হলেন- আলী রা., উমর রা., আব্দুল্লাহ রা., যায়েদ রা., আবুদ্দারদা রা. ও উবাই রা.। এরপর এ ছয় জনকে পর্যবেক্ষণ করে দেখেছি যে, তাদের ইলম কেন্দ্রীভূত রয়েছে দু’জনের মধ্যে-আলী রা. ও আব্দুল্লাহ রা.।
হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. এ অবস্থানে কীভাবে পৌঁছলেন? আল্লাহপ্রদত্ত যোগ্যতা এবং নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দুআ ও সাহচর্য তাঁকে এই অবস্থানে উন্নীত করেছিল।
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন নবুওয়তপ্রাপ্ত হলেন তখন আব্দুল্লাহ রা.-এর বয়স আঠারো-উনিশ বছর। তাঁর বুদ্ধিমত্তা ও আমানতদারী ছিল লক্ষ করার মতো। সে সময়ের এক বিশেষ ঘটনায় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার প্রতি মুগ্ধ হয়েছিলেন। ঘটনাটি ছিল এই যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও আবু বকর সিদ্দীক রা. মরুভূমি দিয়ে কোথাও যাচ্ছিলেন। আব্দুল্লাহ তখন মরুর মাঠে ছাগল চড়াচ্ছিলেন। তিনি তখন উকবা ইবনে আবু মুয়াইত নামক এক লোকের ছাগল চড়াতেন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে বললেন, তোমার কাছে কি দুধ হবে? বালক বলল, ‘হবে, তবে আমানতদার মনে করেই এগুলো চড়ানোর দায়িত্ব আমাকে দেওয়া হয়েছে।’ তাঁর এ উত্তর শুনে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অত্যন্ত খুশি হয়েছিলেন। এরপর তাকে বললেন, তোমার ছাগপালে কি এমন কোনো ছাগল আছে যে এখনও সন্তানধারণের উপযুক্ত হয়নি? (অর্থাৎ যে ছাগলের দুধ দেওয়ার এখনো সময় হয়নি) বালক বলল, জ্বী হাঁ, আছে। সে তার ছাগপাল থেকে একটি ছাগল নবীর খেদমতে পেশ করল। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছাগলটির ওলানে হাত বুলালেন। আল্লাহর কুদরতে সঙ্গে সঙ্গে তা দুধে পরিপূর্ণ হয়ে গেল। এরপর একটি পাথরের পাত্রে সেই দুধ দোহন করা হল। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পান করলেন এবং আবু বকর রা.কেও পান করতে দিলেন। এরপর ওলান আবার আগের মতো হয়ে গেল।
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর এ মুজিযা দেখে আব্দুল্লাহর মনে ঈমানের বীজ রোপিত হল। তিনি নবীজির কাছে ইসলাম গ্রহণ করলেন এবং আরজ করলেন, ইয়া রাসূ্লুল্লাহ! আমাকেও ওই কালাম শিখিয়ে দিন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার মাথায় হাত বুলালেন এবং বললেন, ‘ইন্নাকা গুলাইয়িমুন মুয়াল্লামুন’। আল্লাহ তোমাকে রহম করুন, তুমি একজন সুসভ্য বালক। -মুসনাদে আহমাদ
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছ থেকে আব্দুল্লাহ যে সনদ লাভ করলেন তার সে গুণ নবীর সোহবত পেয়ে বিকশিত হল এবং সুবাস ছড়াল।
তাবেয়ী আব্দুর রহমান ইবনে ইয়াযিদ বলেন, আমরা হযরত হুযাইফা রা.-এর কাছে দরখাস্ত করলাম, ‘আমাদেরকে এমন একজন ব্যক্তিত্বের সন্ধান দিন আচার-আচরণে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সঙ্গে যার গভীর মিল রয়েছে। আমরা তাঁর সাহচর্য অবলম্বন করে উপকৃত হতে চাই।’ হযরত হুযাইফা রা. বললেন, ‘আমার জানামতে আচার-ব্যবহার, চাল-চলন ইত্যাদি সবকিছুতে রাসূলুল্লাহর সঙ্গে সবচেয়ে বেশি মিল হচ্ছে ইবনে উম্মে আবদের (এটা আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা.-এর উপনাম)। সাহাবীগণ জানেন, ইবনে উম্মে আবদই হলেন তাঁদের মধ্যে আল্লাহ তাআলার সর্বাধিক নৈকট্যপ্রাপ্ত।’
হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. ইসলামের প্রথম দিকেই ঈমান এনেছিলেন। এক বর্ণনায় এসেছে, তিনি বলেন, ‘আমি হলাম ষষ্ঠতম মুসলিম। সে সময় ভু-পৃষ্ঠে আমরা ছাড়া আর কোনো মুসলিম ছিল না।’
ইসলামের সেই প্রথম দিকের দিনগুলো ছিল বড় কঠিন। ইসলামের জন্য আব্দুল্লাহ অনেক কষ্ট সহ্য করেছেন। ইসলাম গ্রহণের পর থেকেই আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সোহবত ও খিদমতে এমনভাবে আত্মনিয়োগ করলেন যে, নতুন আগন্তুকরা মনে করত, তিনি নবী-পরিবারেরই সদস্য।
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে যেতে তাঁর অনুমতির প্রয়োজন হতো না। নবীজি তাকে বলে দিয়েছিলেন, তুমি যেকোনো সময় পর্দা উঠিয়ে আমার ঘরে প্রবেশ করতে পারবে এবং আমার একান্ত আলোচনাও শুনতে পারবে। -সহীহ মুসলিম
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সফরে গেলে তাঁর জুতা মোবারক তিনিই বহন করতেন। অজুর পানি, মিসওয়াক, বিছানা ইত্যাদি বহনের খিদমতও তিনিই আঞ্জাম দিতেন।
এই ঐকান্তিক খিদমত ও সাহচর্যের ফল কী হয়েছিল এবং ইলম,আমল ও আল্লাহ তাআলার নৈকট্য অর্জনে তিনি কতদূর অগ্রসর হয়েছিলেন সে কথাই এখন একটু একটু করে বলছি।
হযরত সা’দ ইবনে আবি ওয়াক্কাস রা. বলেন, একবার আমরা ছয়জন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সঙ্গে এক মজলিসে ছিলাম। এমন সময় কিছু কাফির তাঁর কাছে এল এবং অহঙ্কার করে বলল, এদের এখান থেকে তাড়িয়ে দিন, এরা যেন আমাদের উপর কোনো কথা বলতে না পারে। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম চিন্তা করছিলেন। ইতোমধ্যে আয়াত অবতীর্ণ হল। অর্থাৎ সূরা আনআম-এর ৫২ ও ৫৩ নম্বর আয়াত, যার তরজমা হচ্ছে-‘আপনি ওদেরকে দূরে সরিয়ে দিবেন না যারা তাদের পালনকর্তাকে ডাকে সকালে ও সন্ধ্যায়...।’
সে ছয় সৌভাগ্যবানের অন্যতম হলেন হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা.। -সহীহ মুসলিম
উপরোক্ত আয়াতের মাধ্যমে এদের প্রতি বিশেষ মনোযোগ দানের যেন আসমানী নির্দেশ অবতীর্ণ হল। জগতের সর্বশ্রেষ্ঠ মুআল্লিমের সযত্নদৃষ্টি যখন নিবদ্ধ হল তখন মাটির মানুষ ‘সোনার মানুষে’ পরিণত হলেন। জ্ঞান ও প্রজ্ঞা, তাকওয়া ও খোদাভীতিতে তাদের কোনো তুলনা কোথাও রইল না।
কুরআন মাজীদের সঙ্গে হযরত আব্দুল্লাহ মাসউদ রা.-এর ছিল হৃদয়ের সম্পর্ক। সবাই যখন নিদ্রায় অভিভূত হয়ে যেত তখন তার যবান থেকে মৌমাছির গুঞ্জনের মতো কুরআন তেলাওয়াতের ধ্বনি শোনা যেত।
এক রাতে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর দুই প্রিয় সাহাবী আবু বকর রা. ও উমর রা.কে সঙ্গে নিয়ে বের হয়েছেন। মসজিদের এক প্রান্ত থেকে স্পষ্ট ও বিশুদ্ধ স্বরে কুরআন তেলাওয়াতের আওয়াজ শোনা যাচ্ছিল। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বেশ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তেলাওয়াত শুনলেন। এরপর বললেন, ‘যে কুরআনকে সজীবরূপে তেলাওয়াত করতে চায়, যেভাবে তা অবতীর্ণ হয়েছে তাহলে যেন ইবনে উম্মে আবদের মতো তেলাওয়াত করে।’
এদিকে তিলাওয়াতকারী নামায শেষে দুআয় মগ্ন হয়েছেন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অনুচ্চস্বরে বললেন, ‘প্রার্থনা কর তোমাকে দান করা হবে।’ সৌভাগ্যবান দুআকারী সেই শুভ মুহূর্তে না জানি কত কিছু চেয়ে নিয়েছেন। তবে ইতিহাসের পাতায় যতটুকু সংরক্ষিত আছে তারও কোনো তুলনা নেই। তিনি সে দুআয় বলেছেন, ‘ইয়া আল্লাহ! আমি আপনার কাছে এমন ঈমান প্রার্থনা করছি, যা কখনো বিনষ্ট হবে না, এমন নিয়ামত প্রার্থনা করছি, যা কখনো নিঃশেষ হবে না, আর প্রার্থনা করছি আপনার নবীর সাহচর্য চিরশান্তির সর্বোচ্চ জান্নাতে।
ওমর রা. বলেন আমি ভাবলাম, এই সৌভাগ্যের সুসংবাদ আমি তাকে দিব। সকালে যখন তাঁর কাছে গেলাম, দেখি, হযরত আবু বকর আগেই তাকে এ সংবাদ জানিয়ে এসেছেন।
হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. বলেন, ‘আমরা যখন দশ আয়াত শিক্ষা গ্রহণ করতাম তখন এর মর্ম জানার আগে এবং সে অনুযায়ী আমল করার আগে সামনে অগ্রসর হতাম না।’
এই জ্ঞান ও প্রজ্ঞা এবং তাকওয়া ও খোদাভীতির কারণে হযরত উমর রা. তাকে অত্যন্ত সম্মান করতেন এবং মুহাববত করতেন। একদিনের ঘটনা। যায়েদ ইবনে ওয়াহাব বলেন, আমি ওমর রা.-এর নিকট ছিলাম। এমন সময় আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. উপস্থিত হলেন। ছোটখাটো মানুষ ছিলেন, হযরত উমরের চার পাশে বসে থাকা লোকদের কারণে তাকে প্রায় দেখাই যাচ্ছিল না। কিন্তু তার দিকে নজর পড়ামাত্র উমর রা.-এর মুখমন্ডল উজ্জ্বল হাসিতে উদ্ভাসিত হয়ে গেল। কিছুক্ষণ তাঁরা বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা করলেন। তার প্রস্থানের সময় যতক্ষণ তাঁকে দেখা যায় উমর রা. একদৃষ্টিতে সেদিকেই তাকিয়ে রইলেন। এরপর বললেন, ‘কুনাইফুন মুলিআ ইলমা’। অর্থাৎ জ্ঞানে পূর্ণ এক মহা জ্ঞান-পাত্র!
আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. ৩২ হিজরীতে মদীনা মুনাওয়ারায় ইন্তেকাল করেন। কেউ কেউ ৩৩ হিজরীর কথাও বলেছেন। সে সময় তাঁর বয়স ছিল বাষট্টি কিংবা তেষট্টি বছর।
জীবনের শেষ দিকে হযরত উসমান রা.তাঁকে মদীনায় ডেকে পাঠিয়েছিলেন। কুফার অধিবাসীরা বলল, আপনি এখানেই থাকুন। আমরা আপনাকে সব ধরনের সহযোগিতা প্রদান করব। আব্দুল্লাহ বললেন, তাঁর আদেশ পালন করা আমার জন্য অপরিহার্য। আর অচিরেই কিছু অনভিপ্রেত বিষয় এবং ফিৎনা সৃষ্টি হবে যার সূচনাকারী আমি হতে চাই না। একথা বলে তিনি মদীনায় ফিরে গিয়েছিলেন।
উপমহাদেশে হাদীস চর্চাঃ
বাংলা-পাক-ভারত উপমহাদেশে মুসলিম বিজয়ের প্রাক্কাল (৭১২ খৃ.) থেকেই হাদীস চর্চা শুরু হয় এবং এখানে মুসলিম জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে ইসলামী জ্ঞান চর্চাও ব্যাপকতর হয়। ইসলামের প্রচারক ও বাণী বাহকগণ উপমহাদেশের সর্বত্র ইসলামী জ্ঞান চর্চার কেন্দ্র গড়ে তোলেন। খ্যাতনামা মুহাদ্দিস শায়খ শরফুদ্দীন আবু তাওয়ামা (মু. ৭০০ হি.) ৭ম শতকে ঢাকার সোনারগাঁও 'আগমন করেন এবং কুরআন ও হাদীস চর্চার ব্যাপক ব্যবস্থা করেন। বঙ্গদেশের রাজধানী হিসাবে এখানে অসংখ্য হাদীসবেত্তা সমবেত হন এবং ইলমে
হাদীসের জ্ঞান এতদঞ্চলে ছড়িয়ে দেন। মুসলিম শাসনের শেষ পর্যায় পর্যন্ত এই বরকতী ধারা অব্যাহত ছিল। বর্তমান কাল পর্যন্ত এ ধারা অব্যাহত রয়েছে। দারুল উলূম দেওবন্দ, মাযাহিরুল উলূম সাহারানপুর, মাদ্রাসা-ই আলিয়া, ঢাকা, মুঈনুল ইসলাম হাটহাজারী, জামিয়া ইসলামিয়া পটিয়া, জামিয়া কুরআনিয়া আরাবিয়া লালবাগ এবং মারকাযুদ দাওয়াহ আল ইসলামিয়া প্রভৃতি হাদীস কেন্দ্র বর্তমানে ব্যাপকভাবে হাদীস চর্চা ও গবেষণা করে চলেছে। এভাবে যুগ ও বংশ পরস্পরায় মহানবী (সা)-এর হাদীস ভাণ্ডার আমাদের কাছে পৌঁছেছে এবং ইনশাআল্লাহ অব্যাহতভাবে তা অনাগত মানব সভ্যতার কাছে পৌঁছতে থাকবে।